Ajker Patrika

স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাইবিটের দেশীয় পণ্য

অলকানন্দা রায়, ঢাকা
আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০২৩, ১৪: ৫৪
স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বাইবিটের দেশীয় পণ্য

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিকেল ফিজিকস ও টেকনোলজি বিভাগের অনারারি অধ্যাপক এবং প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন অধ্যাপক ড. খন্দকার সিদ্দিক-ই-রাব্বানী। এখন তিনি একদল তরুণের সঙ্গে চিকিৎসাসেবায় ব্যবহারের জন্য নতুন নতুন পণ্য আবিষ্কারের নেশায় কাজ করে চলেছেন নিরলসভাবে। তৈরি করেছেন বেশ কিছু চিকিৎসা উপযোগী পণ্য, যেগুলো সমাদৃত হয়েছে দেশে-বিদেশে।

চিকিৎসকদের পরামর্শে সেই সব পণ্য ব্যবহার করছে রোগীরা। এসব কাজ করার জন্য ড. খন্দকার সিদ্দিক-ই-রাব্বানী প্রতিষ্ঠা করেছেন ‘বাইবিট’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। লক্ষ্য, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে জনগণের দোরগোড়ায় সুলভে স্বাস্থ্যসেবার সুবিধা পৌঁছে দেওয়া। এই প্রতিষ্ঠান ‘কোম্পানি লিমিটেড বাই গ্যারান্টি’ ধারায় নিবন্ধিত। শুধু জনকল্যাণের উদ্দেশ্যে সরকারের এই ধারায় কোম্পানিটি নিবন্ধিত। 
বাইবিট লিমিটেডের আনুষ্ঠানিক পথচলা শুরু হয় ২০১৩ থেকে। এটি ২০১৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টেলিমেডিসিন প্রকল্প এটুআইয়ের 
আর্থিক অনুদান পায়। 

প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভাবিত, উৎপাদিত ও বিপণন করা কিছু পণ্য

  • মাংসপেশির ব্যথায় কার্যকর ইলেকট্রো হেলথ নামক পিইএমএফ যন্ত্র
  • কম্পিউটারাইজড ইসিজি যন্ত্র, ১২ লিড
  • অতিরিক্ত হাত-পা ঘাম নিরোধক অ্যান্টি-সোয়েট যন্ত্র
  • কম্পিউটারাইজড ইএমজি যন্ত্র
  • ডায়াবেটিস রোগীদের পায়ের চাপ মাপার জন্য ডায়নামিক পেডোগ্রাফ যন্ত্র
  • ইন্ট্রা-অপারেটিভ নিউরোমনিটর
  • ফিজিওথেরাপিতে ব্যবহারযোগ্য মাসল ও নার্ভ স্টিমুলেটর
  • ডিজিটাল স্টেথিসকোপ
  • বায়োমেডিকেল ল্যাব ইকুইপমেন্ট 

এসব ছাড়াও প্রতিষ্ঠানটির আরও পণ্য আছে, যা চিকিৎসাসেবায় নানাভাবে কাজে লাগছে।

ইউভিসি রুম ডিসইনফেক্টর

ব্যথা নিরাময়ের যন্ত্র ইলেকট্রো হেলথ
শরীরে ব্যথা নিয়ে কষ্ট পান অনেকে। এদিকে নিয়মিত ব্যথার ওষুধ খাওয়ায় কিডনি ও লিভারের সমস্যা হওয়া, শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া কিংবা হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কাও আছে। এ থেকে মুক্তি দেবে ইলেকট্রো হেলথ। এটি মূলত পালসড ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক ফিল্ড টেকনোলজিভিত্তিক একটি ডিভাইস। এটিতে একটি বৈদ্যুতিক পালস জেনারেটর এবং ব্যথার জায়গায় লাগানোর জন্য একটি ইলেকট্রিক কয়েল থাকে। পালস জেনারেটর দিয়ে মূলত নিয়ন্ত্রিত উপায়ে কয়েলের মধ্য দিয়ে একটি বৈদ্যুতিক প্রবাহ চালনা করা হয়। ফলে শরীরের ভেতরে সূক্ষ্ম রক্তনালিগুলোতে রক্তপ্রবাহ বেড়ে যায় এবং শরীরের কোষগুলো অক্সিজেন ও অন্যান্য উপাদান পায়, যা ব্যথা নিরাময়ে কাজ করে। এটি দেখতে চওড়া কাপড়ের বেল্টের মতো। শরীরের বিভিন্ন জায়গার ব্যথার জন্য বিভিন্নভাবে এটি ব্যবহার করা যায়।

মাসল অ্যান্ড নার্ভ স্টিমুলেটর
কোনো কোনো স্নায়বিক রোগে মাংসপেশি অবশ হয়ে গেলে সেসব চিকিৎসায় বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হয়। এ কাজে যেসব যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, সেগুলো বেশ দামি। এ জন্য অধ্যাপক সিদ্দিক-ই-রাব্বানী সহজলভ্য মাসল অ্যান্ড নার্ভ স্টিমুলেটর ডিজাইন করেন। প্রায় দেড় যুগ ধরে বিএসএমএমইউর ফিজিক্যাল মেডিসিন বিভাগসহ বেশ কিছু ক্লিনিকে এই ডিজাইনের অনেক যন্ত্র রোগীদের চিকিৎসা দিয়ে আসছে। যন্ত্রটি সহজে বহন করা যায়। এতে আছে ব্যথাহীন ফ্যারাডিক স্টিমুলেশন দেওয়ার জন্য বিশেষভাবে বর্ধনশীল পালস ট্রেইন, উন্নত ইলেকট্রেড, সহজ নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা।

অ্যান্টি-সোয়েট
হাত-পায়ের তালুতে অতিরিক্ত ঘাম একটি বিব্রতকর সমস্যা। এ সমস্যা সমাধানে অত্যন্ত কার্যকর পদ্ধতি হচ্ছে আয়োন্টোফোরেসিস। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত এই পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রফেসর রাব্বানী ১৯৯৪ সালে অ্যান্টি-সোয়েট যন্ত্র তৈরি করেন। ইদানীং হাইপারহাইড্রোসিস চিকিৎসায় বাইবিটের অ্যান্টি-সোয়েট যন্ত্রটি বাংলাদেশের চর্মরোগ বিশেষজ্ঞদের কাছে সমাদৃত হচ্ছে।

ইউভিসি রুম ডিসইনফেক্টর
বাইবিটের তৈরি একটি পণ্য রুম ডিসইনফেক্টর। এটি যেকোনো হাসপাতাল, বাড়ি, শপিং মল, স্কুল-কলেজসহ যেকোনো বড় প্রতিষ্ঠান জীবাণুমুক্ত রাখতে ব্যবহার করা যাবে। আলট্রাভায়োলেট-সি লাইট ব্যবহার করে এটি পুরো রুমের যাবতীয় ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা অন্যান্য জীবাণু নির্দিষ্ট সময় পরে মেরে ফেলতে পারে।

ডায়নামিক পেডোগ্রাফ
ডায়নামিক পেডোগ্রাফ যন্ত্রটি তৈরি করার পেছনে রয়েছে ডায়াবেটিস রোগীদের স্নায়বিক সমস্যা। যাঁদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাঁরা ডায়নামিক পেডোগ্রাফে হাঁটার মাধ্যমে পায়ের তলার বিভিন্ন জায়গার প্রেশার পরীক্ষা করতে পারবেন। 
পেডোগ্রাফ মূলত অপটিক্যাল পদ্ধতিতে আলোর পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলনকে ব্যবহার করে হেঁটে যাওয়ার সময় পায়ের তালুর প্রেশার পরিমাপ করে। যন্ত্রের ভেতরে বিশেষভাবে স্থাপন করা একটি ক্যামেরায় পায়ের চাপের ডায়নামিক ছবি সংরক্ষিত হয়। পরবর্তী সময়ে কম্পিউটার সফটওয়্যারে প্রসেস করে কালার-কোডেড প্রেশার ডিস্ট্রিবিউশন প্রদর্শিত হয়। যার ভিত্তিতে কাস্টমাইজড জুতা বা ইনসোল বানানো হয়। এতে একজন ডায়াবেটিস রোগীকে সময়মতো সচেতন করা যায়। ফলে পায়ে ফুট আলসার হওয়া প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। 

নেগেটিভ প্রেশার আইসোলেশন ক্যানোপিনেগেটিভ প্রেশার আইসোলেশন ক্যানোপি
২০২০ সালের কোভিডকালে বাইবিট নিজেদের সক্ষমতা অনুযায়ী বেশ কিছু কার্যকর প্রকল্প গ্রহণ করেছিল। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিএসএমএমইউর গবেষকদের সঙ্গে মিলে প্রফেসর ড. খন্দকার সিদ্দিক-ই-রাব্বানীর নেতৃত্বে নেগেটিভ প্রেশার আইসোলেশন ক্যানোপি উদ্ভাবন করেন। যন্ত্রটি করোনায় আক্রান্ত রোগীকে একটি ক্যানোপির ভেতরে রেখে ভাইরাসযুক্ত বাতাস টেনে আলট্রা-ভায়োলেট রশ্মি ও হেপা ফিল্টারের মাধ্যমে পরিশোধিত করে জীবাণুমুক্ত বাতাস বের করে দেয়। এটি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে কার্যকর।

পেটেন্ট ফ্রি প্রতিষ্ঠান
এই মুক্তবাজার অর্থনীতির পৃথিবীতে আয়ের বড় উৎস পণ্যের পেটেন্ট। কিন্তু বাইবিট কখনোই তাদের উদ্ভাবিত পণ্যের কোনো পেটেন্ট করে না। তারা বিশ্বাস করে, বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিকেন্দ্রিক যে বৈষম্য, তার একটি বড় কারণ পেটেন্টের সংস্কৃতি। তৃতীয় বিশ্বে প্রযুক্তিগত উন্নয়নের জন্য এটি বড় অন্তরায়। বাইবিটের উদ্ভাবিত পণ্য একটি নির্দিষ্ট সময়ের ধারাবাহিক উন্নয়নের পর এর সম্প্রসারণ এবং মানবসম্পদ উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য উপযুক্ত, দক্ষ ও দায়িত্বশীল উদ্ভাবকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।

প্রতিষ্ঠানটি তাদের পণ্যের ডিজাইনে সহজলভ্য প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে। বাইবিট খুব দ্রুত নিজেদের উদ্ভাবিত পণ্যের যেকোনো মেরামত ও উন্নয়ন করতে সক্ষম। প্রতিষ্ঠানটি তার দক্ষতা এবং অর্জিত জ্ঞান নিজেদের ভেতর সীমাবদ্ধ না রেখে প্রতিশ্রুতিশীল তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চায়। তাই তারা বিভিন্ন ধরনের বায়োমেডিকেল ল্যাব ইকুইপমেন্ট তৈরি করেছে, যা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে।

বাইবিটের অর্জন

২০১৮
আইডিইএ স্টার্ট আপ অ্যাওয়ার্ড
২০২১
আইডিএলসি-প্রথম আলো এসএমই পুরস্কার [স্বাস্থ্য]
২০২২
এইচএসবিসি বিজনেস এক্সিলেন্স অ্যাওয়ার্ড [বেস্ট ইন ইনোভেশন অ্যান্ড টেকনোলজি]

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত