বিভুরঞ্জন সরকার
অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ও কার্যপরিধি নিয়ে রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজে আলোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়েছে। এক অংশ মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকার শুধু নির্বাচন পরিচালনার জন্য যথেষ্ট নয়; বিচার বিভাগে সংস্কার, হাসিনা সরকারের হত্যা-নির্যাতন, গুম-খুন ও দুর্নীতির বিচার, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষকরণসহ নানা সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকারকেই সম্পন্ন করা উচিত। তাই নির্বাচন নিয়ে তাড়াহুড়ো না করে অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দিতে হবে। প্রয়োজন হলে ছয় মাস, এক বছর বা তারও বেশি। এমনকি এই সরকারকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় রাখার কথাও সামনে আসছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব মত প্রকাশ পাচ্ছে। আবার ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বিদায়ের কথাও অনেকেই বলছেন। প্রধান উপদেষ্টা নিজে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছেন। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট পথনকশা না দেওয়ায় এ নিয়ে মানুষের মধ্যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকাল নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট বিধিবিধান নেই। এই সরকারের ধারণাটি এসেছে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিশেষ এক পরিস্থিতিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে। মূলত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ব্যাহত না করে শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করাই এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব। এটি কখনোই একটি পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন সরকার নয়। ফলে সাময়িক দায়িত্বপ্রাপ্ত একটি সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র সংস্কারের দায়িত্ব দেওয়ার ধারণা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আত্মাকে আঘাত করে এবং একধরনের প্রশাসনিক কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের ইচ্ছাই হচ্ছে শাসনের বৈধতার ভিত্তি। জনগণই ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে, যারা সরকার পরিচালনা করে। অন্তর্বর্তী সরকার আসলে একটি সেতুবন্ধ—যেখানে বিদায়ী সরকার নির্বাচন আয়োজনের সুযোগ না পেলে, একটি নিরপেক্ষ প্রশাসনিক কাঠামোর মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে সবাই বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে। কিন্তু এই সরকার যদি দীর্ঘায়িত হয়, যদি তারা নীতিনির্ধারণের নামে বিচার বিভাগ পুনর্গঠনের মতো স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ কাজে জড়ায়, তাহলে তারা নিরপেক্ষ রক্ষক থেকে একধরনের অনির্বাচিত অভিভাবকে পরিণত হয়। ইতিহাসে এর ভয়াবহতা বহুবার দেখা গেছে—পাকিস্তানে, থাইল্যান্ডে, এমনকি বাংলাদেশেও। ২০০৭ সালে আমাদের দেশের অভিজ্ঞতা ভোলার মতো নয়।
অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘায়িত হওয়া মূলত দুই ধরনের সমস্যার জন্ম দিতে পারে—এক. সাংবিধানিক শৃঙ্খলা ভেঙে যেতে পারে; দুই. রাজনৈতিক বিভাজন আরও বেড়ে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক চক্র বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আয়োজিত হতে হবে। কোনো অনির্বাচিত সরকার, বিশেষ করে একটি কার্যকর সংসদ ও দায়বদ্ধতার বাইরে থাকা প্রশাসনিক সরকার যদি দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্র চালাতে থাকে, তবে তা অসাংবিধানিক শাসনের শামিল। বিশেষত যখন সেই সরকার সংস্কারের নামে নানা সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তার প্রতি জনসমর্থনের প্রশ্ন ওঠে, কারণ জনগণ তো তাদের ভোট দেয়নি।
যাঁরা বিচার বিভাগের সংস্কার, দুর্নীতিবিরোধী অভিযান, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইত্যাদি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই সম্পন্ন করতে চান, তাঁরা মূলত নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক প্রতিশোধ ও প্রশাসনিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার পথ খোলা রাখতে চান কি না, সেটা বড় বিবেচনার বিষয়। বিচারব্যবস্থায় প্রকৃত সংস্কার একটি দীর্ঘমেয়াদি ও নির্বাচিত সরকারের কাজ। কেননা, বিচার বিভাগে নিয়োগ, প্রশাসনিক সংস্কার, আইনি কাঠামোর পরিবর্তন ইত্যাদি এমন স্পর্শকাতর বিষয়, যা একটি অস্থায়ী সরকার নয়, বরং পূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচিত সরকারই করতে পারে। অন্যথায় সেটি হয় পক্ষপাতমূলক, হয় অপরিণামদর্শী অথবা স্বার্থান্বেষী মহলের চাপের ফসল।
অর্থনৈতিক বিবেচনাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। একটি অন্তর্বর্তী সরকারের দীর্ঘকাল টিকে থাকা দেশীয় ও বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করে। তারা জানে না, এই সরকার কত দিন থাকবে, কী নীতিমালা চালু হবে, নতুন সরকার কবে আসবে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি কোনো বিনিয়োগ পরিকল্পনা করা যায় না। এমনকি বৈদেশিক সহায়তাও বিঘ্নিত হয়। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো সংস্থাগুলো নীতিনির্ধারক ও গণতান্ত্রিকভাবে দায়বদ্ধ সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চায়। ফলে একটি দীর্ঘমেয়াদি অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতিতে একধরনের স্থবিরতা তৈরি করে, যা সাধারণ মানুষের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিক থেকেও এটি অস্বস্তিকর। পৃথিবীর বড় বড় গণতান্ত্রিক দেশ ও জোটসমূহ নির্বাচিত সরকারের সঙ্গেই কূটনৈতিকভাবে জড়িত হতে চায়। অন্তর্বর্তী বা অস্থায়ী সরকারগুলো তাদের নীতিগত অবস্থান প্রকাশ বা আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি প্রদানে সাবধানতা অবলম্বন করে, যা দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে স্থবিরতা তৈরি করে। যেমনটি দেখা গেছে ২০০৭-০৮ সালের বাংলাদেশে।
সবচেয়ে বড় কথা, জনগণের প্রত্যাশা ও অংশগ্রহণের জায়গা থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের দীর্ঘায়ন গণতন্ত্রের মূল আত্মাকে খণ্ডিত করে। জনগণ চায় তারা যেন তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পায় এবং সেই সরকার যেন রাষ্ট্র চালায়। জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। কিন্তু দীর্ঘ সময় একটি অনির্বাচিত, অদৃশ্য বা অগণতান্ত্রিক প্রশাসন রাষ্ট্র চালালে জনগণের ভোটের অধিকার মূল্যহীন হয়ে পড়ে। এতে জনগণের আস্থা হারিয়ে যায়, রাজনীতিতে নিস্পৃহতা আসে আর গণতন্ত্র একটা কাগুজে ব্যবস্থায় পরিণত হয়।
অতীত অভিজ্ঞতাও আমাদের শেখায়, অন্তর্বর্তী সরকারের দীর্ঘায়ন কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৯০ দিনের জায়গায় প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থেকে একদিকে যেমন গণমাধ্যম, রাজনীতি ও নাগরিক পরিসরে ভয়ভীতির সংস্কৃতি চালু করেছিল, অন্যদিকে নির্বাচনের সময়সীমা পিছিয়ে দিয়ে জনগণকে একধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখেছিল। একসময় সেই সরকার নিজেই নানা রাজনৈতিক প্রকল্পে জড়িয়ে পড়ে, যার ফল আজও বহন করতে হচ্ছে। এমন উদাহরণে এটা পরিষ্কার যে, অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচন ছাড়া অন্য কাজে জড়ানো মানেই একটি অজানা অন্ধকার পথে হাঁটা।
সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে যদি অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দীর্ঘ করার কথা বলা হয়, সেটি গণতন্ত্রের স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা, সাংবিধানিক দায়িত্ব, জনগণের অংশগ্রহণ ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা—সবকিছুর বিরুদ্ধেই যায়। পরিবর্তন, সংস্কার বা বিচার চাইলে তার ভার দেওয়া উচিত একটি নির্বাচিত সরকারের ওপরই। সেই সরকার জনগণের ভোটে ক্ষমতায় এসে পরিকল্পিতভাবে বিচার বিভাগ সংস্কার করতে পারে, দুর্নীতিবিরোধী কর্মসূচি নিতে পারে, রাষ্ট্রের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে এসব করানোর কথা বলা মানেই হচ্ছে মূলত গণতন্ত্রকে দীর্ঘ বিরতিতে পাঠানো, যা রাজনৈতিকভাবে আত্মঘাতী এবং নৈতিকভাবে বিপজ্জনক।
তাই এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো দ্রুত নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক একটি জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করা। এই নির্বাচনই দেবে সেই রাজনৈতিক ম্যান্ডেট, যার মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যৎ গঠনের কাজ এগিয়ে নিতে পারে একটি সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার যেন তার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করে গণতন্ত্রের রক্ষক হয়ে থাকে, শাসকের ভূমিকায় নয়। ইতিহাস, বাস্তবতা ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা—সবই আজ এই এককথায় একমত: নির্বাচন হোক, যথাসময়ে হোক, অন্তর্বর্তী সরকার হোক সংক্ষিপ্ত এবং দলনিরপেক্ষ।
অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ ও কার্যপরিধি নিয়ে রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজে আলোচনা ও বিতর্ক শুরু হয়েছে। এক অংশ মনে করে, অন্তর্বর্তী সরকার শুধু নির্বাচন পরিচালনার জন্য যথেষ্ট নয়; বিচার বিভাগে সংস্কার, হাসিনা সরকারের হত্যা-নির্যাতন, গুম-খুন ও দুর্নীতির বিচার, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরপেক্ষকরণসহ নানা সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকারকেই সম্পন্ন করা উচিত। তাই নির্বাচন নিয়ে তাড়াহুড়ো না করে অন্তর্বর্তী সরকারকে সময় দিতে হবে। প্রয়োজন হলে ছয় মাস, এক বছর বা তারও বেশি। এমনকি এই সরকারকে পাঁচ বছর ক্ষমতায় রাখার কথাও সামনে আসছে। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব মত প্রকাশ পাচ্ছে। আবার ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বিদায়ের কথাও অনেকেই বলছেন। প্রধান উপদেষ্টা নিজে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছেন। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট পথনকশা না দেওয়ায় এ নিয়ে মানুষের মধ্যে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকাল নিয়ে কোনো সুস্পষ্ট বিধিবিধান নেই। এই সরকারের ধারণাটি এসেছে গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বিশেষ এক পরিস্থিতিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশে। মূলত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ব্যাহত না করে শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ একটি নির্বাচনের ব্যবস্থা করাই এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব। এটি কখনোই একটি পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন সরকার নয়। ফলে সাময়িক দায়িত্বপ্রাপ্ত একটি সরকারকে গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র সংস্কারের দায়িত্ব দেওয়ার ধারণা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আত্মাকে আঘাত করে এবং একধরনের প্রশাসনিক কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে জনগণের ইচ্ছাই হচ্ছে শাসনের বৈধতার ভিত্তি। জনগণই ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে, যারা সরকার পরিচালনা করে। অন্তর্বর্তী সরকার আসলে একটি সেতুবন্ধ—যেখানে বিদায়ী সরকার নির্বাচন আয়োজনের সুযোগ না পেলে, একটি নিরপেক্ষ প্রশাসনিক কাঠামোর মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যাতে সবাই বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে। কিন্তু এই সরকার যদি দীর্ঘায়িত হয়, যদি তারা নীতিনির্ধারণের নামে বিচার বিভাগ পুনর্গঠনের মতো স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ কাজে জড়ায়, তাহলে তারা নিরপেক্ষ রক্ষক থেকে একধরনের অনির্বাচিত অভিভাবকে পরিণত হয়। ইতিহাসে এর ভয়াবহতা বহুবার দেখা গেছে—পাকিস্তানে, থাইল্যান্ডে, এমনকি বাংলাদেশেও। ২০০৭ সালে আমাদের দেশের অভিজ্ঞতা ভোলার মতো নয়।
অন্তর্বর্তী সরকার দীর্ঘায়িত হওয়া মূলত দুই ধরনের সমস্যার জন্ম দিতে পারে—এক. সাংবিধানিক শৃঙ্খলা ভেঙে যেতে পারে; দুই. রাজনৈতিক বিভাজন আরও বেড়ে গণতন্ত্রের স্বাভাবিক চক্র বাধাগ্রস্ত হতে পারে। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আয়োজিত হতে হবে। কোনো অনির্বাচিত সরকার, বিশেষ করে একটি কার্যকর সংসদ ও দায়বদ্ধতার বাইরে থাকা প্রশাসনিক সরকার যদি দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্র চালাতে থাকে, তবে তা অসাংবিধানিক শাসনের শামিল। বিশেষত যখন সেই সরকার সংস্কারের নামে নানা সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তার প্রতি জনসমর্থনের প্রশ্ন ওঠে, কারণ জনগণ তো তাদের ভোট দেয়নি।
যাঁরা বিচার বিভাগের সংস্কার, দুর্নীতিবিরোধী অভিযান, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইত্যাদি অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনেই সম্পন্ন করতে চান, তাঁরা মূলত নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক প্রতিশোধ ও প্রশাসনিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার পথ খোলা রাখতে চান কি না, সেটা বড় বিবেচনার বিষয়। বিচারব্যবস্থায় প্রকৃত সংস্কার একটি দীর্ঘমেয়াদি ও নির্বাচিত সরকারের কাজ। কেননা, বিচার বিভাগে নিয়োগ, প্রশাসনিক সংস্কার, আইনি কাঠামোর পরিবর্তন ইত্যাদি এমন স্পর্শকাতর বিষয়, যা একটি অস্থায়ী সরকার নয়, বরং পূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাচিত সরকারই করতে পারে। অন্যথায় সেটি হয় পক্ষপাতমূলক, হয় অপরিণামদর্শী অথবা স্বার্থান্বেষী মহলের চাপের ফসল।
অর্থনৈতিক বিবেচনাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। একটি অন্তর্বর্তী সরকারের দীর্ঘকাল টিকে থাকা দেশীয় ও বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা তৈরি করে। তারা জানে না, এই সরকার কত দিন থাকবে, কী নীতিমালা চালু হবে, নতুন সরকার কবে আসবে। ফলে দীর্ঘমেয়াদি কোনো বিনিয়োগ পরিকল্পনা করা যায় না। এমনকি বৈদেশিক সহায়তাও বিঘ্নিত হয়। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো সংস্থাগুলো নীতিনির্ধারক ও গণতান্ত্রিকভাবে দায়বদ্ধ সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চায়। ফলে একটি দীর্ঘমেয়াদি অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতিতে একধরনের স্থবিরতা তৈরি করে, যা সাধারণ মানুষের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিক থেকেও এটি অস্বস্তিকর। পৃথিবীর বড় বড় গণতান্ত্রিক দেশ ও জোটসমূহ নির্বাচিত সরকারের সঙ্গেই কূটনৈতিকভাবে জড়িত হতে চায়। অন্তর্বর্তী বা অস্থায়ী সরকারগুলো তাদের নীতিগত অবস্থান প্রকাশ বা আন্তর্জাতিক প্রতিশ্রুতি প্রদানে সাবধানতা অবলম্বন করে, যা দেশের পররাষ্ট্রনীতিতে স্থবিরতা তৈরি করে। যেমনটি দেখা গেছে ২০০৭-০৮ সালের বাংলাদেশে।
সবচেয়ে বড় কথা, জনগণের প্রত্যাশা ও অংশগ্রহণের জায়গা থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের দীর্ঘায়ন গণতন্ত্রের মূল আত্মাকে খণ্ডিত করে। জনগণ চায় তারা যেন তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পায় এবং সেই সরকার যেন রাষ্ট্র চালায়। জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। কিন্তু দীর্ঘ সময় একটি অনির্বাচিত, অদৃশ্য বা অগণতান্ত্রিক প্রশাসন রাষ্ট্র চালালে জনগণের ভোটের অধিকার মূল্যহীন হয়ে পড়ে। এতে জনগণের আস্থা হারিয়ে যায়, রাজনীতিতে নিস্পৃহতা আসে আর গণতন্ত্র একটা কাগুজে ব্যবস্থায় পরিণত হয়।
অতীত অভিজ্ঞতাও আমাদের শেখায়, অন্তর্বর্তী সরকারের দীর্ঘায়ন কতটা বিপজ্জনক হতে পারে। ২০০৭ সালে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ৯০ দিনের জায়গায় প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থেকে একদিকে যেমন গণমাধ্যম, রাজনীতি ও নাগরিক পরিসরে ভয়ভীতির সংস্কৃতি চালু করেছিল, অন্যদিকে নির্বাচনের সময়সীমা পিছিয়ে দিয়ে জনগণকে একধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে রেখেছিল। একসময় সেই সরকার নিজেই নানা রাজনৈতিক প্রকল্পে জড়িয়ে পড়ে, যার ফল আজও বহন করতে হচ্ছে। এমন উদাহরণে এটা পরিষ্কার যে, অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচন ছাড়া অন্য কাজে জড়ানো মানেই একটি অজানা অন্ধকার পথে হাঁটা।
সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে যদি অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ দীর্ঘ করার কথা বলা হয়, সেটি গণতন্ত্রের স্বাভাবিক ধারাবাহিকতা, সাংবিধানিক দায়িত্ব, জনগণের অংশগ্রহণ ও রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা—সবকিছুর বিরুদ্ধেই যায়। পরিবর্তন, সংস্কার বা বিচার চাইলে তার ভার দেওয়া উচিত একটি নির্বাচিত সরকারের ওপরই। সেই সরকার জনগণের ভোটে ক্ষমতায় এসে পরিকল্পিতভাবে বিচার বিভাগ সংস্কার করতে পারে, দুর্নীতিবিরোধী কর্মসূচি নিতে পারে, রাষ্ট্রের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারে। অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে এসব করানোর কথা বলা মানেই হচ্ছে মূলত গণতন্ত্রকে দীর্ঘ বিরতিতে পাঠানো, যা রাজনৈতিকভাবে আত্মঘাতী এবং নৈতিকভাবে বিপজ্জনক।
তাই এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ হলো দ্রুত নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক একটি জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করা। এই নির্বাচনই দেবে সেই রাজনৈতিক ম্যান্ডেট, যার মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যৎ গঠনের কাজ এগিয়ে নিতে পারে একটি সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার যেন তার নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করে গণতন্ত্রের রক্ষক হয়ে থাকে, শাসকের ভূমিকায় নয়। ইতিহাস, বাস্তবতা ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা—সবই আজ এই এককথায় একমত: নির্বাচন হোক, যথাসময়ে হোক, অন্তর্বর্তী সরকার হোক সংক্ষিপ্ত এবং দলনিরপেক্ষ।
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার একসময় ছিল আন্তর্জাতিক নৈতিকতার শীর্ষ সম্মান—যেখানে পুরস্কার পেতেন তাঁরা, যাঁদের জীবন ও কর্ম বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত। আজ সেই পুরস্কার অনেকটা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক সৌজন্য উপহার। যা দেওয়া হয় যখন কারও হাত মলতে হয়, অহংকারে তেল দিতে হয় বা নিজের অ্যাজেন্ডা...
১২ আগস্ট ২০২৫গত বছর জুলাই মাস থেকে আমাদের আন্দোলনকারী তরুণ ছাত্রছাত্রীদের মুখে ও কিছু কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মুখে, বেশি বেশি করে কয়েকটি বাক্য উচ্চারিত হয়ে আসছিল। বাকিগুলোর মধ্যে প্রথম যে বাক্যটি সবার কানে বেধেছে, সেটা হলো ‘বন্দোবস্ত’।
১২ আগস্ট ২০২৫প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন সম্প্রতি রংপুরে অনুষ্ঠিত এক সভায় যে কথাগুলো বলেছেন, তা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
১২ আগস্ট ২০২৫জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকার অবসানের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এ উপলক্ষে কয়েক দিন ধরে পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনের টক শোতে চলছে এক বছরের মূল্যায়ন।
১১ আগস্ট ২০২৫