বিভুরঞ্জন সরকার
লি কুয়ানের সাফল্যের পেছনের একটি বড় কারণ তিনি একদল বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সহকর্মী পেয়েছিলেন। তাঁদের সমর্থন-সহযোগিতা তাঁর পথচলায় শক্তি জুগিয়েছিল।
একসময় যে সিঙ্গাপুরে ছিল মাত্র ১২০টি জেলে পরিবারের বাস, এখনো ৬০ লাখের কম মানুষের বাস যে ছোট্ট দেশে, সেই সিঙ্গাপুর মাত্র কয়েক বছরের আন্তরিক ও পরিকল্পিত চেষ্টায় পরিণত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্রে। জীবনযাত্রার মান বিবেচনায় সিঙ্গাপুরের অবস্থান এখন এশিয়ায় প্রথম এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নবম। দুর্নীতিমুক্ত যে কয়টি দেশ আছে, সিঙ্গাপুর তার একটি।
পরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে জীবনযাপনে এসেছে অভাবিত পরিবর্তন। মানুষের গড় আয়ু ৮০.৬ বছর। শিক্ষিতের হার ৯৬ শতাংশ। ৯০.১ শতাংশ নাগরিক আবাসন-সুবিধা পেয়েছেন। ভাবা যায়, আদিতে মাছ ধরা ছিল সেখানকার অধিবাসীদের একমাত্র পেশা!
সিঙ্গাপুরের এই অবিশ্বাস্য পরিবর্তনের রূপকার ও কান্ডারি হলেন লি কুয়ান ইউ। ১৯২৩ সালে সিঙ্গাপুরে জন্ম নেওয়া লি কুয়ান যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ থেকে আইনশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। লি কুয়ান অল্প বয়সেই রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত পিপলস অ্যাকশন পার্টির (পিএপি) লি ছিলেন সহপ্রতিষ্ঠাতা। ৪০ বছর তিনি এই দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫৯ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার পর এখন পর্যন্ত টানা ক্ষমতায় আছে পিএপি। লি কুয়ান প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ৩১ বছর। ১৯৯০ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়েন। তত দিনে তিনি সিঙ্গাপুরকে বিস্ময়করভাবে বদলে দিয়েছেন। অপরাধ ও দারিদ্র্যপীড়িত একটি ছোট বন্দর শহরকে এশিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা খুব সহজ কাজ ছিল না।
১৯৫৯ সালে স্বায়ত্তশাসন লাভ করার পর ১৯৬৩ সালে মালয়েশিয়ার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল সিঙ্গাপুর। কিন্তু আদর্শগত কারণে সেই মিলন বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৬৫ সালে সম্পূর্ণ স্বাধীন হয় দেশটি।
মালয়েশিয়া থেকে সিঙ্গাপুরকে আলাদা করে দেওয়ার সময় ১৯৬৫ সালের ৯ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে লি কুয়ান বলেছিলেন, ‘এটি আমার জন্য খুবই যন্ত্রণার মুহূর্ত, কারণ আমার সারা জীবন আমি এ দুই ভূখণ্ডের একত্রীকরণ ও ঐক্যে বিশ্বাস করে এসেছি। আপনারা জানেন আমাদের জনগণ, যারা ভূগোল, অর্থনীতি এবং সম্পর্কের মধ্য দিয়ে একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। তবে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।
অনেক কিছুই আগের মতো স্বাভাবিকভাবে চলতে থাকবে। আমরা সিঙ্গাপুরে বহু জাতিসত্তার সমন্বয়ে একটি জাতি পেতে যাচ্ছি, যেখানে সবাই সমভাবে নিজের ঠিকানা পাবে, যা অবশ্যই ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মের ভিত্তিতে নয়।’
মালয়েশিয়া যখন সিঙ্গাপুরকে আলাদা করে দেয়, তখন লি কুয়ানের কাছে মনে হয়েছিল এ তো শরীর ছাড়া হৃৎপিণ্ড—ইট বিকাম এ হার্ট উইদাউট বডি।
অথচ সেই সিঙ্গাপুর এখন প্রায় সব ক্ষেত্রেই মালয়েশিয়াকে ছাড়িয়ে গেছে। সিঙ্গাপুরের সাফল্যের পেছনে একটি বড় কারণ সম্ভবত এই যে, সেখানে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার একেবারেই নেই। বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও ঐক্য বজায় রাখতে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন লি কুয়ান। সব ধরনের অপরাধ ও দুর্নীতি বন্ধে নেওয়া হয়েছিল শক্ত অবস্থান। সিঙ্গাপুরকে পরিচ্ছন্ন ও সবুজ রাষ্ট্রে পরিণত করার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের অন্যতম একটি বাসযোগ্য শহরে পরিণত করার একক কৃতিত্ব লি কুয়ানের।
আমরা অনেকেই এখন সিঙ্গাপুর যাই। কিন্তু আমাদের চেয়ে সব দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা এত ছোট এবং স্বল্প জনসংখ্যার একটি দেশ কীভাবে, কোন কৌশলে, কোন রাজনীতি অনুসরণ করে এত সাফল্য পেল, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো প্রশ্ন বা আত্মজিজ্ঞাসা জাগে বলে মনে হয় না। আমরা গণতন্ত্র নিয়ে, ভোট নিয়ে, গদি দখল নিয়ে, ধর্ম নিয়ে যত সোচ্চার ও বিচলিত, মানুষকে মানুষের মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ নিশ্চিত করার ব্যাপারে ততটাই নীরব এবং নিষ্ক্রিয়।
বাংলাদেশের অনেক মানুষ সিঙ্গাপুরে আছেন। এর মধ্যে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যাই বেশি। যেসব বাঙালি সিঙ্গাপুরে আছেন, তাঁরা সেখানকার সরকার ও রাজনীতি সম্পর্কে খুব বেশি উৎসাহ আছে, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয় না।
লি কুয়ানের সুযোগ্য নেতৃত্বে সিঙ্গাপুর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই প্রথমে উন্নতিশীল এবং বর্তমানে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে চলে আসে। লি কুয়ান ন্যায়সংগত শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে পুঁজিবাদী ধাঁচে সিঙ্গাপুরকে একটি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তিনি একজন শক্তিধর রাষ্ট্রনায়ক তথা সফল সরকার পরিচালক হিসেবে দুনিয়াজুড়েই পরিচিতি ও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। স্বাধীন সিঙ্গাপুরের যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তাঁর বয়স ৪২ বছর। তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে কম বয়সী।
লি কুয়ান পরবর্তী সময়ে তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন: আমি তাঁদের সবার চেয়ে বয়সে কনিষ্ঠ ছিলাম। তারপরও তাঁরা কখনো আমার কোনো কাজে বাধা দেননি। নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়েও দেননি। এমনকি আমি যখন কোনো ভুল করেছি, তখনো তাঁরা আমার বিরোধিতা করেননি। তাঁরা সব সময় আমাকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে অবস্থান করতে সহায়তা করেছেন এবং আমার ভেতরে যেন ‘মুই কি হনু রে’ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ আত্মম্ভরিতার প্রকাশ না ঘটে, সে বিষয়ে সচেতন থেকেছেন।
লি কুয়ানের সাফল্যের পেছনের আর একটি বড় কারণ তিনি একদল বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সহকর্মী পেয়েছিলেন। তাঁদের সমর্থন-সহযোগিতা তাঁর পথচলায় শক্তি জুগিয়েছিল। শুধু কি তাই? লি কুয়ান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে দেশের উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করতেন।
উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন তিনি। বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও ঐক্য বজায় রাখতে কড়া পদক্ষেপ গ্রহণে কোনো দ্বিধা করেননি।
ইউরোপ-আমেরিকার মতো সিঙ্গাপুরে এত মানবাধিকার, গণতন্ত্র ইত্যাদির চর্চা নেই। সেখানে গণতন্ত্রের নামে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা করতে দেওয়া হয় না কাউকে। বিশৃঙ্খলা কঠোর হাতে দমন করা হয়। সিঙ্গাপুরে রাজনৈতিক দল আছে অনেক। কিন্তু শুরু থেকে এখন পর্যন্ত একটি দলই শাসনক্ষমতায় আছে। ভোটে নির্বাচিত হয়েই ক্ষমতাসীন দল সরকার গঠন করে। বিরোধী দলের জনসমর্থন একেবারেই কম। ক্ষমতায় থাকা বা যাওয়ার জন্য প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। পুরো নগররাষ্ট্রটি কঠোর নিয়ম-নীতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত।
আইনের কড়াকড়ি সিঙ্গাপুরে প্রবল। আইন না মানা বা অমান্য করার সুযোগ কারও নেই। আইনের প্রশ্নে কারও কোনো ছাড় নেই। এখনো বেত্রাঘাত, মৃত্যুদণ্ডসহ কঠিন শাস্তি বহাল আছে। নিজেদের ভালো-মন্দের ব্যাপারে সিঙ্গাপুর পরদেশের পরামর্শ শোনে না, গ্রাহ্য করে না।
উন্নয়নের জন্য লি কুয়ান বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। তবে ‘মানবাধিকার’ প্রশ্নে সমালোচিত হলেও শক্ত হাতে দেশ শাসনের নীতি থেকে তিনি পিছু হটেননি। বিরোধীদের ব্যাপারে তাঁর উদারতা, সহনশীলতা ছিল কম। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, গণবিক্ষোভ, মিছিল-সমাবেশ ইত্যাদি নিয়ে কাউকে খুব উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায় না।
সিঙ্গাপুরের মানুষ কেন সরকারবিরোধী নয়, এক দলই কেন বারবার ক্ষমতায় থাকছে, মানুষ কেন পরিবর্তনপ্রত্যাশী নয়—এ বিষয়গুলো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হওয়া উচিত। কম গণতন্ত্র কীভাবে মানুষের স্বস্তির কারণ হয়, সেটা নিশ্চয়ই কৌতূহলের বিষয়।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লির কঠোর মনোভাবের একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে লেখাটি শেষ করব। শাসনকালের শুরু থেকেই তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছিলেন অত্যন্ত কঠোর এবং অনমনীয়। দুর্নীতির প্রশ্নে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদেরও এতটুকু ছাড় দিতেন না। লির এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু তেহ চেয়াং ওয়ানকে জাতীয় উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত মন্ত্রী ছিলেন। তেহর বিরুদ্ধে শেষ দিকে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ উঠলে তিনি লিকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থা বা দুর্নীতি দমন সংস্থা যেন একটু নমনীয়তা দেখায়।
লি তাঁর বন্ধু এবং সহকর্মী তেহকে বলেছিলেন, তদন্ত সংস্থার কাজে হস্তক্ষেপ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব না। যাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাকে সেই দায়িত্ব পালনে বাধা দিলে সিস্টেম ভেঙে পড়বে। আর সিস্টেম একবার ভেঙে পড়লে সিঙ্গাপুরও আর অগ্রসর হবে না। তেহ যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলেন। বাসায় ফিরে একটি সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যা করেছিলেন ১৯৮৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর। একটি নোট লিখে নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিজেই নিজের সর্বোচ্চ শাস্তি বেছে নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন।
প্রিয় সহযোদ্ধার এই পরিণতিতে বেদনাবিদ্ধ হলেও লি তাঁর শোকবাণীতে বলেছিলেন, দেশের জন্য কাজ করার অঙ্গীকার নিয়ে মন্ত্রী হলেই কারও আইন, বিচার বা তদন্ত প্রক্রিয়ার বাইরে থাকার অধিকার তৈরি হয় না। তেহর প্রতি তিনি নমনীয়তা দেখালে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ত। তাতে হয়তো তেহর জীবন কিছুটা দীর্ঘ হতো কিন্তু দুর্বল হয়ে পড়ত সিঙ্গাপুরের শাসনব্যবস্থা। ব্যক্তির প্রতি আবেগ বা ভালোবাসা না দেখিয়ে দেশের প্রতি ভালোবাসা দেখানোর দৃঢ়তা দেখাতে পেরেছিলেন বলেই লির সিঙ্গাপুর একটি ছোট্ট দেশ হয়েও বড় দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে।
সিঙ্গাপুর কেন পেরেছে আর আমরা কেন পারছি না, তা কি বোঝা যাচ্ছে?
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
লি কুয়ানের সাফল্যের পেছনের একটি বড় কারণ তিনি একদল বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সহকর্মী পেয়েছিলেন। তাঁদের সমর্থন-সহযোগিতা তাঁর পথচলায় শক্তি জুগিয়েছিল।
একসময় যে সিঙ্গাপুরে ছিল মাত্র ১২০টি জেলে পরিবারের বাস, এখনো ৬০ লাখের কম মানুষের বাস যে ছোট্ট দেশে, সেই সিঙ্গাপুর মাত্র কয়েক বছরের আন্তরিক ও পরিকল্পিত চেষ্টায় পরিণত হয়েছে বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্রে। জীবনযাত্রার মান বিবেচনায় সিঙ্গাপুরের অবস্থান এখন এশিয়ায় প্রথম এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে নবম। দুর্নীতিমুক্ত যে কয়টি দেশ আছে, সিঙ্গাপুর তার একটি।
পরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে জীবনযাপনে এসেছে অভাবিত পরিবর্তন। মানুষের গড় আয়ু ৮০.৬ বছর। শিক্ষিতের হার ৯৬ শতাংশ। ৯০.১ শতাংশ নাগরিক আবাসন-সুবিধা পেয়েছেন। ভাবা যায়, আদিতে মাছ ধরা ছিল সেখানকার অধিবাসীদের একমাত্র পেশা!
সিঙ্গাপুরের এই অবিশ্বাস্য পরিবর্তনের রূপকার ও কান্ডারি হলেন লি কুয়ান ইউ। ১৯২৩ সালে সিঙ্গাপুরে জন্ম নেওয়া লি কুয়ান যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ থেকে আইনশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন। লি কুয়ান অল্প বয়সেই রাজনীতিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত পিপলস অ্যাকশন পার্টির (পিএপি) লি ছিলেন সহপ্রতিষ্ঠাতা। ৪০ বছর তিনি এই দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৫৯ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হওয়ার পর এখন পর্যন্ত টানা ক্ষমতায় আছে পিএপি। লি কুয়ান প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ৩১ বছর। ১৯৯০ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়েন। তত দিনে তিনি সিঙ্গাপুরকে বিস্ময়করভাবে বদলে দিয়েছেন। অপরাধ ও দারিদ্র্যপীড়িত একটি ছোট বন্দর শহরকে এশিয়ার সবচেয়ে সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করা খুব সহজ কাজ ছিল না।
১৯৫৯ সালে স্বায়ত্তশাসন লাভ করার পর ১৯৬৩ সালে মালয়েশিয়ার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল সিঙ্গাপুর। কিন্তু আদর্শগত কারণে সেই মিলন বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। ১৯৬৫ সালে সম্পূর্ণ স্বাধীন হয় দেশটি।
মালয়েশিয়া থেকে সিঙ্গাপুরকে আলাদা করে দেওয়ার সময় ১৯৬৫ সালের ৯ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলনে লি কুয়ান বলেছিলেন, ‘এটি আমার জন্য খুবই যন্ত্রণার মুহূর্ত, কারণ আমার সারা জীবন আমি এ দুই ভূখণ্ডের একত্রীকরণ ও ঐক্যে বিশ্বাস করে এসেছি। আপনারা জানেন আমাদের জনগণ, যারা ভূগোল, অর্থনীতি এবং সম্পর্কের মধ্য দিয়ে একে অন্যের সঙ্গে যুক্ত। তবে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই।
অনেক কিছুই আগের মতো স্বাভাবিকভাবে চলতে থাকবে। আমরা সিঙ্গাপুরে বহু জাতিসত্তার সমন্বয়ে একটি জাতি পেতে যাচ্ছি, যেখানে সবাই সমভাবে নিজের ঠিকানা পাবে, যা অবশ্যই ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্মের ভিত্তিতে নয়।’
মালয়েশিয়া যখন সিঙ্গাপুরকে আলাদা করে দেয়, তখন লি কুয়ানের কাছে মনে হয়েছিল এ তো শরীর ছাড়া হৃৎপিণ্ড—ইট বিকাম এ হার্ট উইদাউট বডি।
অথচ সেই সিঙ্গাপুর এখন প্রায় সব ক্ষেত্রেই মালয়েশিয়াকে ছাড়িয়ে গেছে। সিঙ্গাপুরের সাফল্যের পেছনে একটি বড় কারণ সম্ভবত এই যে, সেখানে রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার একেবারেই নেই। বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও ঐক্য বজায় রাখতে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন লি কুয়ান। সব ধরনের অপরাধ ও দুর্নীতি বন্ধে নেওয়া হয়েছিল শক্ত অবস্থান। সিঙ্গাপুরকে পরিচ্ছন্ন ও সবুজ রাষ্ট্রে পরিণত করার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের অন্যতম একটি বাসযোগ্য শহরে পরিণত করার একক কৃতিত্ব লি কুয়ানের।
আমরা অনেকেই এখন সিঙ্গাপুর যাই। কিন্তু আমাদের চেয়ে সব দিক দিয়ে পিছিয়ে থাকা এত ছোট এবং স্বল্প জনসংখ্যার একটি দেশ কীভাবে, কোন কৌশলে, কোন রাজনীতি অনুসরণ করে এত সাফল্য পেল, তা নিয়ে আমাদের মধ্যে কোনো প্রশ্ন বা আত্মজিজ্ঞাসা জাগে বলে মনে হয় না। আমরা গণতন্ত্র নিয়ে, ভোট নিয়ে, গদি দখল নিয়ে, ধর্ম নিয়ে যত সোচ্চার ও বিচলিত, মানুষকে মানুষের মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার সুযোগ নিশ্চিত করার ব্যাপারে ততটাই নীরব এবং নিষ্ক্রিয়।
বাংলাদেশের অনেক মানুষ সিঙ্গাপুরে আছেন। এর মধ্যে শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যাই বেশি। যেসব বাঙালি সিঙ্গাপুরে আছেন, তাঁরা সেখানকার সরকার ও রাজনীতি সম্পর্কে খুব বেশি উৎসাহ আছে, তাঁদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয় না।
লি কুয়ানের সুযোগ্য নেতৃত্বে সিঙ্গাপুর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই প্রথমে উন্নতিশীল এবং বর্তমানে উন্নত রাষ্ট্রের কাতারে চলে আসে। লি কুয়ান ন্যায়সংগত শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে পুঁজিবাদী ধাঁচে সিঙ্গাপুরকে একটি জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন। তিনি একজন শক্তিধর রাষ্ট্রনায়ক তথা সফল সরকার পরিচালক হিসেবে দুনিয়াজুড়েই পরিচিতি ও খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। স্বাধীন সিঙ্গাপুরের যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তাঁর বয়স ৪২ বছর। তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে কম বয়সী।
লি কুয়ান পরবর্তী সময়ে তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন: আমি তাঁদের সবার চেয়ে বয়সে কনিষ্ঠ ছিলাম। তারপরও তাঁরা কখনো আমার কোনো কাজে বাধা দেননি। নিজেদের সিদ্ধান্ত চাপিয়েও দেননি। এমনকি আমি যখন কোনো ভুল করেছি, তখনো তাঁরা আমার বিরোধিতা করেননি। তাঁরা সব সময় আমাকে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে অবস্থান করতে সহায়তা করেছেন এবং আমার ভেতরে যেন ‘মুই কি হনু রে’ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ আত্মম্ভরিতার প্রকাশ না ঘটে, সে বিষয়ে সচেতন থেকেছেন।
লি কুয়ানের সাফল্যের পেছনের আর একটি বড় কারণ তিনি একদল বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সহকর্মী পেয়েছিলেন। তাঁদের সমর্থন-সহযোগিতা তাঁর পথচলায় শক্তি জুগিয়েছিল। শুধু কি তাই? লি কুয়ান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে দেশের উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বলে মনে করতেন।
উগ্র জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন তিনি। বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও ঐক্য বজায় রাখতে কড়া পদক্ষেপ গ্রহণে কোনো দ্বিধা করেননি।
ইউরোপ-আমেরিকার মতো সিঙ্গাপুরে এত মানবাধিকার, গণতন্ত্র ইত্যাদির চর্চা নেই। সেখানে গণতন্ত্রের নামে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা করতে দেওয়া হয় না কাউকে। বিশৃঙ্খলা কঠোর হাতে দমন করা হয়। সিঙ্গাপুরে রাজনৈতিক দল আছে অনেক। কিন্তু শুরু থেকে এখন পর্যন্ত একটি দলই শাসনক্ষমতায় আছে। ভোটে নির্বাচিত হয়েই ক্ষমতাসীন দল সরকার গঠন করে। বিরোধী দলের জনসমর্থন একেবারেই কম। ক্ষমতায় থাকা বা যাওয়ার জন্য প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। পুরো নগররাষ্ট্রটি কঠোর নিয়ম-নীতির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত।
আইনের কড়াকড়ি সিঙ্গাপুরে প্রবল। আইন না মানা বা অমান্য করার সুযোগ কারও নেই। আইনের প্রশ্নে কারও কোনো ছাড় নেই। এখনো বেত্রাঘাত, মৃত্যুদণ্ডসহ কঠিন শাস্তি বহাল আছে। নিজেদের ভালো-মন্দের ব্যাপারে সিঙ্গাপুর পরদেশের পরামর্শ শোনে না, গ্রাহ্য করে না।
উন্নয়নের জন্য লি কুয়ান বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। তবে ‘মানবাধিকার’ প্রশ্নে সমালোচিত হলেও শক্ত হাতে দেশ শাসনের নীতি থেকে তিনি পিছু হটেননি। বিরোধীদের ব্যাপারে তাঁর উদারতা, সহনশীলতা ছিল কম। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, গণবিক্ষোভ, মিছিল-সমাবেশ ইত্যাদি নিয়ে কাউকে খুব উচ্চবাচ্য করতে দেখা যায় না।
সিঙ্গাপুরের মানুষ কেন সরকারবিরোধী নয়, এক দলই কেন বারবার ক্ষমতায় থাকছে, মানুষ কেন পরিবর্তনপ্রত্যাশী নয়—এ বিষয়গুলো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হওয়া উচিত। কম গণতন্ত্র কীভাবে মানুষের স্বস্তির কারণ হয়, সেটা নিশ্চয়ই কৌতূহলের বিষয়।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লির কঠোর মনোভাবের একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে লেখাটি শেষ করব। শাসনকালের শুরু থেকেই তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে ছিলেন অত্যন্ত কঠোর এবং অনমনীয়। দুর্নীতির প্রশ্নে তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদেরও এতটুকু ছাড় দিতেন না। লির এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু তেহ চেয়াং ওয়ানকে জাতীয় উন্নয়ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত মন্ত্রী ছিলেন। তেহর বিরুদ্ধে শেষ দিকে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগ উঠলে তিনি লিকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত সংস্থা বা দুর্নীতি দমন সংস্থা যেন একটু নমনীয়তা দেখায়।
লি তাঁর বন্ধু এবং সহকর্মী তেহকে বলেছিলেন, তদন্ত সংস্থার কাজে হস্তক্ষেপ করা তাঁর পক্ষে সম্ভব না। যাকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তাকে সেই দায়িত্ব পালনে বাধা দিলে সিস্টেম ভেঙে পড়বে। আর সিস্টেম একবার ভেঙে পড়লে সিঙ্গাপুরও আর অগ্রসর হবে না। তেহ যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলেন। বাসায় ফিরে একটি সুইসাইড নোট লিখে আত্মহত্যা করেছিলেন ১৯৮৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর। একটি নোট লিখে নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিজেই নিজের সর্বোচ্চ শাস্তি বেছে নেওয়ার কথা জানিয়েছিলেন।
প্রিয় সহযোদ্ধার এই পরিণতিতে বেদনাবিদ্ধ হলেও লি তাঁর শোকবাণীতে বলেছিলেন, দেশের জন্য কাজ করার অঙ্গীকার নিয়ে মন্ত্রী হলেই কারও আইন, বিচার বা তদন্ত প্রক্রিয়ার বাইরে থাকার অধিকার তৈরি হয় না। তেহর প্রতি তিনি নমনীয়তা দেখালে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ত। তাতে হয়তো তেহর জীবন কিছুটা দীর্ঘ হতো কিন্তু দুর্বল হয়ে পড়ত সিঙ্গাপুরের শাসনব্যবস্থা। ব্যক্তির প্রতি আবেগ বা ভালোবাসা না দেখিয়ে দেশের প্রতি ভালোবাসা দেখানোর দৃঢ়তা দেখাতে পেরেছিলেন বলেই লির সিঙ্গাপুর একটি ছোট্ট দেশ হয়েও বড় দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছে।
সিঙ্গাপুর কেন পেরেছে আর আমরা কেন পারছি না, তা কি বোঝা যাচ্ছে?
লেখক: সহকারী সম্পাদক, আজকের পত্রিকা
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার একসময় ছিল আন্তর্জাতিক নৈতিকতার শীর্ষ সম্মান—যেখানে পুরস্কার পেতেন তাঁরা, যাঁদের জীবন ও কর্ম বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত। আজ সেই পুরস্কার অনেকটা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক সৌজন্য উপহার। যা দেওয়া হয় যখন কারও হাত মলতে হয়, অহংকারে তেল দিতে হয় বা নিজের অ্যাজেন্ডা...
১২ আগস্ট ২০২৫গত বছর জুলাই মাস থেকে আমাদের আন্দোলনকারী তরুণ ছাত্রছাত্রীদের মুখে ও কিছু কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মুখে, বেশি বেশি করে কয়েকটি বাক্য উচ্চারিত হয়ে আসছিল। বাকিগুলোর মধ্যে প্রথম যে বাক্যটি সবার কানে বেধেছে, সেটা হলো ‘বন্দোবস্ত’।
১২ আগস্ট ২০২৫প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন সম্প্রতি রংপুরে অনুষ্ঠিত এক সভায় যে কথাগুলো বলেছেন, তা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
১২ আগস্ট ২০২৫জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকার অবসানের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এ উপলক্ষে কয়েক দিন ধরে পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনের টক শোতে চলছে এক বছরের মূল্যায়ন।
১১ আগস্ট ২০২৫