বিভুরঞ্জন সরকার
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সংঘাত ও সংকট যখন তীব্র আকার ধারণ করে, তখন শান্তি প্রতিষ্ঠার আশায় জাতিসংঘের দিকে তাকিয়ে থাকে বিশ্ব। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জাতিসংঘ কি সত্যিই কার্যকরভাবে সংকট সমাধান করতে পারে, নাকি এটি শুধুই একটি প্রতীকী সংস্থা, যা আলোচনার বাইরে তেমন কিছু করতে পারে না?
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তাঁর এই সফর নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্ছ্বাস সবাই লক্ষ করেছেন। ১৩ মার্চ বৃহস্পতিবার বিকেলে চার দিনের সফরে ঢাকায় আসেন গুতেরেস। আসার পরদিন শুক্রবার কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে ‘সলিডারিটি ইফতার’ করেন। এর পরদিন শনিবার ঢাকার গুলশানে জাতিসংঘের নতুন ভবন উদ্বোধনসহ নানা কর্মসূচিতে যোগ দেন তিনি। দুপুরে রাজনৈতিক দল ও ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপ শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন তিনি।
বলা হচ্ছে, জাতিসংঘ মহাসচিবের সফর থেকে ড. ইউনূসের সরকার অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই লাভবান হয়েছে। এই লাভটা কীভাবে নিরূপণ করা হয়েছে, সে প্রশ্নের অবশ্য জবাব পাওয়া যাবে না। কোন পক্ষের আগ্রহে সফরটি হয়েছে, সেটা কি আমাদের কাছে খুব পরিষ্কার? বলা হয়েছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে তিনি এসেছিলেন। আবার তিনি নিজে বলেছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে ইফতার করার জন্যই তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। প্রতিবছরই সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সঙ্গে ইফতার করা আন্তোনিও গুতেরেসের একটি শখ। এবার রোহিঙ্গারা তাঁর সঙ্গে ইফতারে শরিক হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে—এটা কম কথা নয়।
জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশে আসায় ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকার যে স্বস্তি ও তৃপ্তি পেয়েছে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। গণমাধ্যম কয়েক দিন তাঁর সফর নিয়ে মেতে থাকল। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপ সামলাতে সরকার যখন হিমশিম খাচ্ছে, তখন একজন বিশিষ্ট মেহমানকে নিয়ে নানা তৎপরতায় মেতে থাকতে পারা সরকারের জন্য তৃপ্তিদায়ক হয়েছে বইকি! তবে দু্ই দিন আগে হোক আর পরে হোক, এই প্রশ্ন তো উঠবেই যে এই সফরের ফলে কাজের কাজ কী হলো? রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যা সমাধানের পথ কি খুলল? তাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা কি বাড়ল? মিয়ানমারের সামরিক জান্তার ওপর আন্তর্জাতিক চাপ এর ফলে বাড়বে, নাকি জাতিসংঘ মহাসচিব আরাকান রাজ্যে মানবিক সাহায্য পাঠানোর করিডর হওয়ার প্রস্তাবে বাংলাদেশের ঝুঁকি বাড়ল? ঢাকায় জাতিসংঘ অফিস যে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করল, তারই-বা উদ্দেশ্য কী? বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে কিছু করার সুযোগ জাতিসংঘের কতটুকু আছে? তাহলে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে কথা চালাচালি করে কে কী পেল?
জাতিসংঘ মহাসচিবের বাংলাদেশ সফর এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাঁর বৈঠকের গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় কেউ কেউ এই বৈঠককে গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেও অনেকেই আবার এটাকে লোক দেখানো ফাঁপা বেলুন ওড়ানো বলতে দ্বিধা করছেন না। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে কিছুটা বিরক্তির সঙ্গেই বলেছেন, বৈঠকটি কেন করা হলো সেটা তাঁর কাছে স্পষ্ট নয়।
জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটের চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই বৈঠকে বিএনপি, জামায়াত, গণসংহতি আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টি, এবি পার্টি, সিপিবিসহ বেশ কয়েকটি দলের নেতারা উপস্থিত থেকে মূলত দুটি বিষয়—সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করেছেন।
বৈঠকের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে যে দলটি বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য মনে করলেও সাংবিধানিক কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তনের আগে একটি দ্রুত নির্বাচন চায়। তাদের মতে, নির্বাচনের জন্য ন্যূনতম সংস্কার জরুরি, তবে বৃহত্তর সাংবিধানিক সংস্কার পরে করা যেতে পারে। এটি একটি কৌশলগত অবস্থান, যেখানে তারা নির্বাচনকে দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কারের শর্তে আটকে রাখতে চাচ্ছে না, বরং একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের বিদায়কে প্রাথমিক লক্ষ হিসেবে দেখছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং কিছু ছোট দল, বিশেষত এবি পার্টির সংস্কারের প্রশ্নে কঠোর অবস্থান স্পষ্ট করেছে। তারা মনে করছে, নির্বাচন শুধু একটি প্রক্রিয়া, কিন্তু যদি কাঠামোগত সমস্যা ঠিক না করা হয়, তাহলে সেটি আবার অনিয়মের শিকার হতে পারে। এনসিপির মতে, এই সরকারের অধীনেই সংস্কারের প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে, অর্থাৎ নির্বাচনের আগে বড় ধরনের সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক সংস্কার দরকার। এটি মূলত বিএনপির অবস্থানের বিপরীত। বিএনপি যেখানে দ্রুত নির্বাচন চায়, সেখানে এনসিপি বলছে, সংস্কার ছাড়া নির্বাচন অর্থহীন।
জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন ও ক্ষমতার প্রশ্নে কৌশলী ভূমিকা রেখেছে। তাদের বক্তব্যে দুটি বিষয় উঠে এসেছে—একটি হলো ‘টেকসই গণতন্ত্র ও জাতীয় ঐক্য’ নিয়ে কথা বলা, যা মূলত ক্ষমতায় ফেরার একটি নীতি হতে পারে এবং দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের মাধ্যমে পরিবর্তন আনার কথা বলা, যা ইঙ্গিত দেয় যে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ খোলা রাখতে চায়। যদিও বিএনপির সঙ্গে তাদের ‘ঐতিহাসিক’ মৈত্রী বন্ধন রয়েছে, তবু তাদের বক্তব্যে সংস্কার ও নির্বাচনের বিষয়টি আলাদা করে তোলা হয়েছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে তারা ভবিষ্যতে বিএনপির কৌশলের সঙ্গে পুরোপুরি একমত নাও থাকতে পারে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকির বক্তব্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করার দিকে বেশি মনোযোগী ছিল। তিনি জুলাই গণহত্যার বিচার ও জাতিসংঘের সহায়তার বিষয়ে জোর দিয়েছেন, যা মূলত একটি মানবাধিকারকেন্দ্রিক রাজনৈতিক কৌশল। তবে তাঁদের দলও নির্বাচনের প্রশ্নে সংস্কারের প্রক্রিয়ার গুরুত্ব দিয়েছে, যা বিএনপির অবস্থানের তুলনায় তুলনামূলক বেশি সময়সাপেক্ষ ও কাঠামোগত পরিবর্তন চায়।
বৈঠকের পর স্পষ্ট হয়েছে যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কার ও নির্বাচনের প্রশ্নে একধরনের বিভাজন রয়ে গেছে। এই বিভাজনের কারণে ঐকমত্যের সম্ভাবনা খুব বেশি দৃঢ় নয়। বিএনপি যদি নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দেয়, তবে অন্য দলগুলোর সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়তে পারে, যা বৃহত্তর ঐক্য তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করবে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই বৈঠকে বেশির ভাগ বিষয়কেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং সহায়তা করার আশ্বাস দিয়েছেন। তবে তাঁর বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে তিনি সরাসরি কোনো পক্ষ নিতে চাননি। জাতিসংঘ সাধারণত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও মানবাধিকারসংক্রান্ত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে আগ্রহী হলেও, সরাসরি রাজনৈতিক পরিবর্তনে তাদের ভূমিকা সীমিত।
এবার আসা যাক রোহিঙ্গা ইস্যুতে। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব কি নতুন কোনো আশার বাণী শুনিয়েছেন? যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থী ও তাদের আতিথেয়তাকারী বাংলাদেশি জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশের জন্যই আমি বাংলাদেশ সফরের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
আগামী মাস থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা কমে গেলে ভয়াবহ মানবিক সংকট তৈরি হবে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন জাতিসংঘ মহাসচিব। কিন্তু সেই সংকট কীভাবে কাটবে তার কোনো রূপরেখা দেননি মহাসচিব। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ইফতার অনুষ্ঠানে গুতেরেস স্পষ্ট করে বলেছিলেন, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান। তাই সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকেরা জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে প্রশ্ন রাখেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কী উদ্যোগ নেওয়া হবে?
জবাবে জাতিসংঘ প্রধান বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি হলো, মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং আরাকান আর্মির মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ চলছে। এই পরিস্থিতিতে অবিলম্বে এবং সম্মানজনকভাবে প্রত্যাবর্তন অত্যন্ত কঠিন হবে, তা স্পষ্ট।’
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আরাকান আর্মিকেও আলোচনায় যুক্ত করা উচিত বলে উল্লেখ করে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘আরাকান আর্মিও এখন একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমি মনে করি, তাদের
সঙ্গেও প্রয়োজনীয় সংলাপ হওয়া উচিত। কারণ আমরা জানি যে অতীতে রাখাইন এবং রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক সহজ ছিল না।’
জাতিসংঘ মহাসচিবের এই প্রস্তাবটি কি কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের জন্য খুব ভালো হবে? আরাকান আর্মি কোনো বৈধ পক্ষ নয়, তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ সংলাপ শুরু করলে মিয়ানমারের সরকার সেটা কীভাবে নেবে?
রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতিতে সেখানে মানবিক সহায়তা পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ করিডর হিসেবে ব্যবহার হতে পারে—এমন একটি আলোচনা ছিল গত কয়েক দিন। সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিব এই প্রশ্নে বলেছেন, ‘মিয়ানমারের ভেতরে মানবিক সহায়তা জোরদার করা জরুরি, যাতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়। এ কারণেই, যদি পরিস্থিতি অনুকূল হয়, বাংলাদেশ থেকে মানবিক সহায়তা চ্যানেল চালু করাও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।’
মানবিক সহায়তার করিডর হিসেবে বাংলাদেশ ব্যবহৃত হলে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসনের পরিবেশ মসৃণ নাকি আরও জটিল হবে—সে প্রশ্ন কূটনৈতিক মহলে আলোচিত হচ্ছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সংঘাত ও সংকট যখন তীব্র আকার ধারণ করে, তখন শান্তি প্রতিষ্ঠার আশায় জাতিসংঘের দিকে তাকিয়ে থাকে বিশ্ব। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জাতিসংঘ কি সত্যিই কার্যকরভাবে সংকট সমাধান করতে পারে, নাকি এটি শুধুই একটি প্রতীকী সংস্থা, যা আলোচনার বাইরে তেমন কিছু করতে পারে না? কারও কারও মতে, জাতিসংঘের ভূমিকা মেঘবৃষ্টির পর আকাশে দেখা দেওয়া রংধনুর মতো—যা দেখতে সুন্দর, সাময়িক চোখ জুড়ানো ছাড়া তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না—এমন ধারণাও অনেকের রয়েছে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক,আজকের পত্রিকা
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সংঘাত ও সংকট যখন তীব্র আকার ধারণ করে, তখন শান্তি প্রতিষ্ঠার আশায় জাতিসংঘের দিকে তাকিয়ে থাকে বিশ্ব। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জাতিসংঘ কি সত্যিই কার্যকরভাবে সংকট সমাধান করতে পারে, নাকি এটি শুধুই একটি প্রতীকী সংস্থা, যা আলোচনার বাইরে তেমন কিছু করতে পারে না?
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তাঁর এই সফর নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্ছ্বাস সবাই লক্ষ করেছেন। ১৩ মার্চ বৃহস্পতিবার বিকেলে চার দিনের সফরে ঢাকায় আসেন গুতেরেস। আসার পরদিন শুক্রবার কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন ও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে ‘সলিডারিটি ইফতার’ করেন। এর পরদিন শনিবার ঢাকার গুলশানে জাতিসংঘের নতুন ভবন উদ্বোধনসহ নানা কর্মসূচিতে যোগ দেন তিনি। দুপুরে রাজনৈতিক দল ও ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপ শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন তিনি।
বলা হচ্ছে, জাতিসংঘ মহাসচিবের সফর থেকে ড. ইউনূসের সরকার অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রেই লাভবান হয়েছে। এই লাভটা কীভাবে নিরূপণ করা হয়েছে, সে প্রশ্নের অবশ্য জবাব পাওয়া যাবে না। কোন পক্ষের আগ্রহে সফরটি হয়েছে, সেটা কি আমাদের কাছে খুব পরিষ্কার? বলা হয়েছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে তিনি এসেছিলেন। আবার তিনি নিজে বলেছেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে ইফতার করার জন্যই তিনি বাংলাদেশে এসেছেন। প্রতিবছরই সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সঙ্গে ইফতার করা আন্তোনিও গুতেরেসের একটি শখ। এবার রোহিঙ্গারা তাঁর সঙ্গে ইফতারে শরিক হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে—এটা কম কথা নয়।
জাতিসংঘ মহাসচিব বাংলাদেশে আসায় ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকার যে স্বস্তি ও তৃপ্তি পেয়েছে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। গণমাধ্যম কয়েক দিন তাঁর সফর নিয়ে মেতে থাকল। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপ সামলাতে সরকার যখন হিমশিম খাচ্ছে, তখন একজন বিশিষ্ট মেহমানকে নিয়ে নানা তৎপরতায় মেতে থাকতে পারা সরকারের জন্য তৃপ্তিদায়ক হয়েছে বইকি! তবে দু্ই দিন আগে হোক আর পরে হোক, এই প্রশ্ন তো উঠবেই যে এই সফরের ফলে কাজের কাজ কী হলো? রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যা সমাধানের পথ কি খুলল? তাদের স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা কি বাড়ল? মিয়ানমারের সামরিক জান্তার ওপর আন্তর্জাতিক চাপ এর ফলে বাড়বে, নাকি জাতিসংঘ মহাসচিব আরাকান রাজ্যে মানবিক সাহায্য পাঠানোর করিডর হওয়ার প্রস্তাবে বাংলাদেশের ঝুঁকি বাড়ল? ঢাকায় জাতিসংঘ অফিস যে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করল, তারই-বা উদ্দেশ্য কী? বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিষয়ে কিছু করার সুযোগ জাতিসংঘের কতটুকু আছে? তাহলে সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে কথা চালাচালি করে কে কী পেল?
জাতিসংঘ মহাসচিবের বাংলাদেশ সফর এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাঁর বৈঠকের গুরুত্ব ও তাৎপর্য নিয়ে নানামুখী আলোচনা চলছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় কেউ কেউ এই বৈঠককে গুরুত্বপূর্ণ মনে করলেও অনেকেই আবার এটাকে লোক দেখানো ফাঁপা বেলুন ওড়ানো বলতে দ্বিধা করছেন না। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে কিছুটা বিরক্তির সঙ্গেই বলেছেন, বৈঠকটি কেন করা হলো সেটা তাঁর কাছে স্পষ্ট নয়।
জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বৈঠকের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটের চিত্র স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই বৈঠকে বিএনপি, জামায়াত, গণসংহতি আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টি, এবি পার্টি, সিপিবিসহ বেশ কয়েকটি দলের নেতারা উপস্থিত থেকে মূলত দুটি বিষয়—সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করেছেন।
বৈঠকের পর বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে যে দলটি বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনকে অগ্রহণযোগ্য মনে করলেও সাংবিধানিক কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তনের আগে একটি দ্রুত নির্বাচন চায়। তাদের মতে, নির্বাচনের জন্য ন্যূনতম সংস্কার জরুরি, তবে বৃহত্তর সাংবিধানিক সংস্কার পরে করা যেতে পারে। এটি একটি কৌশলগত অবস্থান, যেখানে তারা নির্বাচনকে দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত সংস্কারের শর্তে আটকে রাখতে চাচ্ছে না, বরং একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের বিদায়কে প্রাথমিক লক্ষ হিসেবে দেখছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এবং কিছু ছোট দল, বিশেষত এবি পার্টির সংস্কারের প্রশ্নে কঠোর অবস্থান স্পষ্ট করেছে। তারা মনে করছে, নির্বাচন শুধু একটি প্রক্রিয়া, কিন্তু যদি কাঠামোগত সমস্যা ঠিক না করা হয়, তাহলে সেটি আবার অনিয়মের শিকার হতে পারে। এনসিপির মতে, এই সরকারের অধীনেই সংস্কারের প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে, অর্থাৎ নির্বাচনের আগে বড় ধরনের সাংবিধানিক ও প্রশাসনিক সংস্কার দরকার। এটি মূলত বিএনপির অবস্থানের বিপরীত। বিএনপি যেখানে দ্রুত নির্বাচন চায়, সেখানে এনসিপি বলছে, সংস্কার ছাড়া নির্বাচন অর্থহীন।
জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন ও ক্ষমতার প্রশ্নে কৌশলী ভূমিকা রেখেছে। তাদের বক্তব্যে দুটি বিষয় উঠে এসেছে—একটি হলো ‘টেকসই গণতন্ত্র ও জাতীয় ঐক্য’ নিয়ে কথা বলা, যা মূলত ক্ষমতায় ফেরার একটি নীতি হতে পারে এবং দ্বিতীয়ত, নির্বাচনের মাধ্যমে পরিবর্তন আনার কথা বলা, যা ইঙ্গিত দেয় যে তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণের পথ খোলা রাখতে চায়। যদিও বিএনপির সঙ্গে তাদের ‘ঐতিহাসিক’ মৈত্রী বন্ধন রয়েছে, তবু তাদের বক্তব্যে সংস্কার ও নির্বাচনের বিষয়টি আলাদা করে তোলা হয়েছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে তারা ভবিষ্যতে বিএনপির কৌশলের সঙ্গে পুরোপুরি একমত নাও থাকতে পারে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকির বক্তব্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করার দিকে বেশি মনোযোগী ছিল। তিনি জুলাই গণহত্যার বিচার ও জাতিসংঘের সহায়তার বিষয়ে জোর দিয়েছেন, যা মূলত একটি মানবাধিকারকেন্দ্রিক রাজনৈতিক কৌশল। তবে তাঁদের দলও নির্বাচনের প্রশ্নে সংস্কারের প্রক্রিয়ার গুরুত্ব দিয়েছে, যা বিএনপির অবস্থানের তুলনায় তুলনামূলক বেশি সময়সাপেক্ষ ও কাঠামোগত পরিবর্তন চায়।
বৈঠকের পর স্পষ্ট হয়েছে যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংস্কার ও নির্বাচনের প্রশ্নে একধরনের বিভাজন রয়ে গেছে। এই বিভাজনের কারণে ঐকমত্যের সম্ভাবনা খুব বেশি দৃঢ় নয়। বিএনপি যদি নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দেয়, তবে অন্য দলগুলোর সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়তে পারে, যা বৃহত্তর ঐক্য তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করবে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এই বৈঠকে বেশির ভাগ বিষয়কেই বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন এবং সহায়তা করার আশ্বাস দিয়েছেন। তবে তাঁর বক্তব্য থেকে বোঝা যায় যে তিনি সরাসরি কোনো পক্ষ নিতে চাননি। জাতিসংঘ সাধারণত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও মানবাধিকারসংক্রান্ত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে আগ্রহী হলেও, সরাসরি রাজনৈতিক পরিবর্তনে তাদের ভূমিকা সীমিত।
এবার আসা যাক রোহিঙ্গা ইস্যুতে। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব কি নতুন কোনো আশার বাণী শুনিয়েছেন? যৌথ সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থী ও তাদের আতিথেয়তাকারী বাংলাদেশি জনগণের প্রতি সংহতি প্রকাশের জন্যই আমি বাংলাদেশ সফরের সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
আগামী মাস থেকে রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা কমে গেলে ভয়াবহ মানবিক সংকট তৈরি হবে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন জাতিসংঘ মহাসচিব। কিন্তু সেই সংকট কীভাবে কাটবে তার কোনো রূপরেখা দেননি মহাসচিব। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে ইফতার অনুষ্ঠানে গুতেরেস স্পষ্ট করে বলেছিলেন, বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনই রোহিঙ্গা সংকটের একমাত্র সমাধান। তাই সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকেরা জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে প্রশ্ন রাখেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে কী উদ্যোগ নেওয়া হবে?
জবাবে জাতিসংঘ প্রধান বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতি হলো, মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং আরাকান আর্মির মধ্যে তীব্র সংঘর্ষ চলছে। এই পরিস্থিতিতে অবিলম্বে এবং সম্মানজনকভাবে প্রত্যাবর্তন অত্যন্ত কঠিন হবে, তা স্পষ্ট।’
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আরাকান আর্মিকেও আলোচনায় যুক্ত করা উচিত বলে উল্লেখ করে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, ‘আরাকান আর্মিও এখন একটি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আমি মনে করি, তাদের
সঙ্গেও প্রয়োজনীয় সংলাপ হওয়া উচিত। কারণ আমরা জানি যে অতীতে রাখাইন এবং রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক সহজ ছিল না।’
জাতিসংঘ মহাসচিবের এই প্রস্তাবটি কি কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশের জন্য খুব ভালো হবে? আরাকান আর্মি কোনো বৈধ পক্ষ নয়, তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ সংলাপ শুরু করলে মিয়ানমারের সরকার সেটা কীভাবে নেবে?
রাখাইনের বর্তমান পরিস্থিতিতে সেখানে মানবিক সহায়তা পাঠানোর জন্য বাংলাদেশ করিডর হিসেবে ব্যবহার হতে পারে—এমন একটি আলোচনা ছিল গত কয়েক দিন। সংবাদ সম্মেলনে জাতিসংঘ মহাসচিব এই প্রশ্নে বলেছেন, ‘মিয়ানমারের ভেতরে মানবিক সহায়তা জোরদার করা জরুরি, যাতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হয়। এ কারণেই, যদি পরিস্থিতি অনুকূল হয়, বাংলাদেশ থেকে মানবিক সহায়তা চ্যানেল চালু করাও গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।’
মানবিক সহায়তার করিডর হিসেবে বাংলাদেশ ব্যবহৃত হলে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসনের পরিবেশ মসৃণ নাকি আরও জটিল হবে—সে প্রশ্ন কূটনৈতিক মহলে আলোচিত হচ্ছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সংঘাত ও সংকট যখন তীব্র আকার ধারণ করে, তখন শান্তি প্রতিষ্ঠার আশায় জাতিসংঘের দিকে তাকিয়ে থাকে বিশ্ব। কিন্তু প্রশ্ন হলো, জাতিসংঘ কি সত্যিই কার্যকরভাবে সংকট সমাধান করতে পারে, নাকি এটি শুধুই একটি প্রতীকী সংস্থা, যা আলোচনার বাইরে তেমন কিছু করতে পারে না? কারও কারও মতে, জাতিসংঘের ভূমিকা মেঘবৃষ্টির পর আকাশে দেখা দেওয়া রংধনুর মতো—যা দেখতে সুন্দর, সাময়িক চোখ জুড়ানো ছাড়া তেমন কোনো প্রভাব ফেলে না—এমন ধারণাও অনেকের রয়েছে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক,আজকের পত্রিকা
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার একসময় ছিল আন্তর্জাতিক নৈতিকতার শীর্ষ সম্মান—যেখানে পুরস্কার পেতেন তাঁরা, যাঁদের জীবন ও কর্ম বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত। আজ সেই পুরস্কার অনেকটা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক সৌজন্য উপহার। যা দেওয়া হয় যখন কারও হাত মলতে হয়, অহংকারে তেল দিতে হয় বা নিজের অ্যাজেন্ডা...
১২ আগস্ট ২০২৫গত বছর জুলাই মাস থেকে আমাদের আন্দোলনকারী তরুণ ছাত্রছাত্রীদের মুখে ও কিছু কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মুখে, বেশি বেশি করে কয়েকটি বাক্য উচ্চারিত হয়ে আসছিল। বাকিগুলোর মধ্যে প্রথম যে বাক্যটি সবার কানে বেধেছে, সেটা হলো ‘বন্দোবস্ত’।
১২ আগস্ট ২০২৫প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন সম্প্রতি রংপুরে অনুষ্ঠিত এক সভায় যে কথাগুলো বলেছেন, তা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
১২ আগস্ট ২০২৫জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকার অবসানের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এ উপলক্ষে কয়েক দিন ধরে পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনের টক শোতে চলছে এক বছরের মূল্যায়ন।
১১ আগস্ট ২০২৫