অরুণ কর্মকার
রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ের একটি উঁচু ভবনে কয়েক দিন আগে ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে গঠিত উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বিদ্যুতের লুজ কানেকশন থেকে ওই ঘটনার সূত্রপাত বলে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। সে সিদ্ধান্তের আলোকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাৎক্ষণিকভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, ওই লুজ কানেকশন মেরামত করাসহ সচিবালয়ে অগ্নিনিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণের। তাতে বোঝা গেল যে সরকার তদন্ত কমিটির ওই প্রতিবেদন যথার্থ বলে মেনে নিয়েছে। তবে জনপরিসরে ওই প্রতিবেদন যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ, ওই অগ্নিকাণ্ডের বিষয়টি নিয়ে সর্বত্রই কিছু কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা হয়। তার মধ্যে যতগুলো শুনেছি তাতে তদন্ত প্রতিবেদনটি মানুষ বিশ্বাস করতে পারেনি বলে আমার মনে হচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়ে জবাব মেলে না। তার মধ্যে একটি বিষয় হলো, সেখানে একটি কুকুরের পোড়া মৃতদেহ পাওয়া গেছে। হতভাগ্য কুকুরটি কীভাবে আটতলার ওই কক্ষে গিয়েছিল, মানুষ জানে না? দ্বিতীয় হলো, সংবাদমাধ্যমে খবর বের হয়েছিল যে পুড়ে যাওয়া ফ্লোরগুলোতে গানপাউডার ছড়ানো ছিল। যদি তা না-ই হয়, এমন একটি খবর এল কী করে? সে বিষয়ে তদন্ত কমিটি কি সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যমের বক্তব্য জানতে চেয়েছিল? কেউ জানে না। অবশ্য বিদ্যুতের লুজ কানেকশন যে থাকতে পারে এবং তা একটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কারণও হতে পারে, সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণের কোনো কারণ নেই।
লুজ কানেকশনের কথা যখন উঠেছে তখন বলে নেওয়া দরকার যে লুজ কানেকশন শুধু সচিবালয়ে এবং বিদ্যুতের নয়। বাংলাদেশের ৫৩ বছরের পথচলায় অসংখ্য ক্ষেত্রে ভয়ানক সব লুজ কানেকশন সৃষ্টি হয়েছে, সৃষ্টি করা হয়েছে। লুজ কানেকশন রয়েছে দেশের রাজনীতিতে। আছে অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি, শিল্প-বাণিজ্য, এমনকি সামাজিক সম্পর্কেও। এর সবগুলো লুজ কানেকশনই সৃষ্টি হয়েছে রাষ্ট্রের মৌলিক নীতিনৈতিকতা নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে একপেশে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং কোটারি স্বার্থ রক্ষার অব্যাহত চেষ্টার কারণে। মানুষের মনে সন্দেহ, এ দেশে দীর্ঘকাল ধরে সৃষ্টি হওয়া এ রকম কোনো একটি লুজ কানেকশন সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের পেছনের কারণ নয় তো? অবশ্য এটাকে মানুষের এই সন্দেহবাতিক বলেও ধরে নেওয়া যায়। অবশ্য সন্দেহটি মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে সরকারের কোনো একটি বক্তব্যের কারণে। এ দেশের মানুষ সরকারের কথা অবিশ্বাস করতে করতে একধরনের বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। অবশ্য দীর্ঘকাল ধরে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের অসত্য ভাষণও মানুষকে বাতিকগ্রস্ত করে তোলার পেছনের কারণ।
সে যা-ই হোক, লুজ কানেকশন সৃষ্টির এই প্রক্রিয়া শুরু হয় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পর থেকেই। কিংবা বলা যায়, এই রাষ্ট্র গঠনের জন্য ১৯৭১ সালের সেই ‘পুরোনো’ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই। সেই লুজ কানেকশন সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে তার প্রকৃত লক্ষ্যাভিমুখ থেকে বিচ্যুত করা। এই লুজ কানেকশন প্রথমে সৃষ্টি করা হয় রাজনৈতিক অঙ্গনে। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ক্রমান্বয়ে হয়ে ওঠে সর্বব্যাপী। যত দিন গেছে ততই এইসব লুজ কানেকশনের সংখ্যা বেড়েছে এবং সেগুলো লুজ হতে হতে একেবারে ‘পাতলুন খুলে পড়ে যাওয়ার উপক্রম’ হয়েছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বার্থে লুজ কানেকশনগুলো মেরামত করাই হচ্ছে আসল কাজ।
আমরা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম, যাঁরা রণাঙ্গনে ছিলাম, তাঁরা সেই স্বপ্নগুলো বারবার বেহাত হয়ে যেতে দেখেছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ছিল অভিন্ন জাতীয় সংস্কৃতির ছায়াতলে সব প্রকার বৈষম্যহীন একটি সমাজ। রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ একটি দেশ। আমাদের স্বপ্ন ছিল সুশাসন, সবার জন্য শিক্ষা-চিকিৎসার অধিকার। সেই সব স্বপ্নই বিলীন হয়ে গেছে। আমাদের প্রজন্ম ঐক্যবদ্ধভাবে সেটা ধরে রাখতে পারিনি। সেই ব্যর্থতাজনিত কষ্টের কোনো সীমা নেই। আসলে আমাদের ব্যর্থ করে দিয়েছে দেশের নীতিনৈতিকতাবর্জিত স্বেচ্ছাচারী রাজনীতি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই সৃষ্টি করা রাজনৈতিক বিভক্তি ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে পরিণত হয়। হত্যা-সন্ত্রাস, সামরিক অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান আমাদের প্রজন্মকে দিশাহারা করে ফেলে। একসময় এ দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দেওয়া যেত না। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠেছিল একটা গালির মতো। এগুলোর কারণ ছিল রাজনীতিতে লুজ কানেকশন।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ঋণখেলাপির সংস্কৃতি, দুর্নীতি, নৈতিকতাহীন ব্যবসা স্বাধীন দেশে ক্রমাগতভাবে ছড়িয়ে পড়েছে রাষ্ট্র থেকে সমাজের সর্বত্র। কেবল এ দেশের সাধারণ মানুষ সব সময়ই ছিল এর বাইরে এবং নীরব প্রতিবাদকারী। কারণ প্রতিবাদে সরব হওয়ার সুযোগ তাদের ছিল না দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির কারণে। স্বাধীন দেশের প্রত্যাশা অনুযায়ী দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের যাত্রা শুরু হলেও অচিরেই তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে বিজাতীয় সংস্কৃতি। তারপর বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা, দুর্নীতি-দুঃশাসন ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হতে থাকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ফলে পর্যায়ক্রমে দেশে স্বেচ্ছাচারী, একদেশদর্শী শাসনব্যবস্থা দেশকে কবজা করে নেয়। সব ক্ষেত্রে কানেকশনগুলো লুজ হয়ে যাওয়া কিংবা লুজ করে দেওয়ার কারণেই এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
রাষ্ট্র ও সমাজের প্রায় সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জন্মের পর থেকে সৃষ্টি হওয়া বা সৃষ্টি করে আসা সেই লুজ কানেকশনগুলো মেরামতের ভার পড়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাঁধে। একটি অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থান এই কাজের ভার তাদের কাঁধে চাপিয়েছে। এই কাজে ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ যেমন তাদের নেই, তেমনি এই কাজ সম্পন্ন করাও মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ। অন্তর্বর্তী সরকার দৃশ্যত সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে। কিন্তু রাজনীতির কূটকৌশল তা কতটা সফল হতে দেবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া কঠিন। কারণ কতগুলো লুজ কানেকশন খুবই স্পর্শকাতর। উদাহরণ হিসেবে রাষ্ট্রধর্মের কথা বলা যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশন এবং ওই কমিশন যাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় পরামর্শ সভায় বসেছে, তারা সংবিধানের অনেক সংস্কার, পরিবর্তনের কথা বলেছে। কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম সম্পর্কে কেউ টুঁ শব্দটি করেছে বলে শুনিনি। তবে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃত রেখে একটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক দেশ গঠন কীভাবে সম্ভব এই প্রশ্ন অনেকেই বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তুলে থাকেন। এই সমস্যার সমাধানও থাকতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রমে। সেই কারণেই সব লুজ কানেকশনের সাফল্য নিয়ে অনিশ্চয়তা।
এই অনিশ্চয়তা কাটিয়েই অন্তর্বর্তী সরকারকে সফল হতে হবে।
রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ের একটি উঁচু ভবনে কয়েক দিন আগে ঘটে যাওয়া অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে গঠিত উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বিদ্যুতের লুজ কানেকশন থেকে ওই ঘটনার সূত্রপাত বলে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। সে সিদ্ধান্তের আলোকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাৎক্ষণিকভাবে নির্দেশ দিয়েছেন, ওই লুজ কানেকশন মেরামত করাসহ সচিবালয়ে অগ্নিনিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণের। তাতে বোঝা গেল যে সরকার তদন্ত কমিটির ওই প্রতিবেদন যথার্থ বলে মেনে নিয়েছে। তবে জনপরিসরে ওই প্রতিবেদন যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ, ওই অগ্নিকাণ্ডের বিষয়টি নিয়ে সর্বত্রই কিছু কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা হয়। তার মধ্যে যতগুলো শুনেছি তাতে তদন্ত প্রতিবেদনটি মানুষ বিশ্বাস করতে পারেনি বলে আমার মনে হচ্ছে। ওই প্রতিবেদনে অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়ে জবাব মেলে না। তার মধ্যে একটি বিষয় হলো, সেখানে একটি কুকুরের পোড়া মৃতদেহ পাওয়া গেছে। হতভাগ্য কুকুরটি কীভাবে আটতলার ওই কক্ষে গিয়েছিল, মানুষ জানে না? দ্বিতীয় হলো, সংবাদমাধ্যমে খবর বের হয়েছিল যে পুড়ে যাওয়া ফ্লোরগুলোতে গানপাউডার ছড়ানো ছিল। যদি তা না-ই হয়, এমন একটি খবর এল কী করে? সে বিষয়ে তদন্ত কমিটি কি সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যমের বক্তব্য জানতে চেয়েছিল? কেউ জানে না। অবশ্য বিদ্যুতের লুজ কানেকশন যে থাকতে পারে এবং তা একটি ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কারণও হতে পারে, সে বিষয়ে সন্দেহ পোষণের কোনো কারণ নেই।
লুজ কানেকশনের কথা যখন উঠেছে তখন বলে নেওয়া দরকার যে লুজ কানেকশন শুধু সচিবালয়ে এবং বিদ্যুতের নয়। বাংলাদেশের ৫৩ বছরের পথচলায় অসংখ্য ক্ষেত্রে ভয়ানক সব লুজ কানেকশন সৃষ্টি হয়েছে, সৃষ্টি করা হয়েছে। লুজ কানেকশন রয়েছে দেশের রাজনীতিতে। আছে অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি, শিল্প-বাণিজ্য, এমনকি সামাজিক সম্পর্কেও। এর সবগুলো লুজ কানেকশনই সৃষ্টি হয়েছে রাষ্ট্রের মৌলিক নীতিনৈতিকতা নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে একপেশে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং কোটারি স্বার্থ রক্ষার অব্যাহত চেষ্টার কারণে। মানুষের মনে সন্দেহ, এ দেশে দীর্ঘকাল ধরে সৃষ্টি হওয়া এ রকম কোনো একটি লুজ কানেকশন সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের পেছনের কারণ নয় তো? অবশ্য এটাকে মানুষের এই সন্দেহবাতিক বলেও ধরে নেওয়া যায়। অবশ্য সন্দেহটি মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে সরকারের কোনো একটি বক্তব্যের কারণে। এ দেশের মানুষ সরকারের কথা অবিশ্বাস করতে করতে একধরনের বাতিকগ্রস্ত হয়ে পড়েছে বললে অত্যুক্তি হবে না। অবশ্য দীর্ঘকাল ধরে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়ে সরকারের অসত্য ভাষণও মানুষকে বাতিকগ্রস্ত করে তোলার পেছনের কারণ।
সে যা-ই হোক, লুজ কানেকশন সৃষ্টির এই প্রক্রিয়া শুরু হয় স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পর থেকেই। কিংবা বলা যায়, এই রাষ্ট্র গঠনের জন্য ১৯৭১ সালের সেই ‘পুরোনো’ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই। সেই লুজ কানেকশন সৃষ্টির উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে তার প্রকৃত লক্ষ্যাভিমুখ থেকে বিচ্যুত করা। এই লুজ কানেকশন প্রথমে সৃষ্টি করা হয় রাজনৈতিক অঙ্গনে। তারপর তা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। ক্রমান্বয়ে হয়ে ওঠে সর্বব্যাপী। যত দিন গেছে ততই এইসব লুজ কানেকশনের সংখ্যা বেড়েছে এবং সেগুলো লুজ হতে হতে একেবারে ‘পাতলুন খুলে পড়ে যাওয়ার উপক্রম’ হয়েছে। এই অবস্থায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বার্থে লুজ কানেকশনগুলো মেরামত করাই হচ্ছে আসল কাজ।
আমরা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্ম, যাঁরা রণাঙ্গনে ছিলাম, তাঁরা সেই স্বপ্নগুলো বারবার বেহাত হয়ে যেতে দেখেছি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন ছিল অভিন্ন জাতীয় সংস্কৃতির ছায়াতলে সব প্রকার বৈষম্যহীন একটি সমাজ। রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ একটি দেশ। আমাদের স্বপ্ন ছিল সুশাসন, সবার জন্য শিক্ষা-চিকিৎসার অধিকার। সেই সব স্বপ্নই বিলীন হয়ে গেছে। আমাদের প্রজন্ম ঐক্যবদ্ধভাবে সেটা ধরে রাখতে পারিনি। সেই ব্যর্থতাজনিত কষ্টের কোনো সীমা নেই। আসলে আমাদের ব্যর্থ করে দিয়েছে দেশের নীতিনৈতিকতাবর্জিত স্বেচ্ছাচারী রাজনীতি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই সৃষ্টি করা রাজনৈতিক বিভক্তি ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে পরিণত হয়। হত্যা-সন্ত্রাস, সামরিক অভ্যুত্থান-পাল্টা অভ্যুত্থান আমাদের প্রজন্মকে দিশাহারা করে ফেলে। একসময় এ দেশে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দেওয়া যেত না। মুক্তিযোদ্ধা হয়ে উঠেছিল একটা গালির মতো। এগুলোর কারণ ছিল রাজনীতিতে লুজ কানেকশন।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ঋণখেলাপির সংস্কৃতি, দুর্নীতি, নৈতিকতাহীন ব্যবসা স্বাধীন দেশে ক্রমাগতভাবে ছড়িয়ে পড়েছে রাষ্ট্র থেকে সমাজের সর্বত্র। কেবল এ দেশের সাধারণ মানুষ সব সময়ই ছিল এর বাইরে এবং নীরব প্রতিবাদকারী। কারণ প্রতিবাদে সরব হওয়ার সুযোগ তাদের ছিল না দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির কারণে। স্বাধীন দেশের প্রত্যাশা অনুযায়ী দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের যাত্রা শুরু হলেও অচিরেই তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে বিজাতীয় সংস্কৃতি। তারপর বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা, দুর্নীতি-দুঃশাসন ব্যাপকভাবে বিস্তৃত হতে থাকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার প্রবণতা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ফলে পর্যায়ক্রমে দেশে স্বেচ্ছাচারী, একদেশদর্শী শাসনব্যবস্থা দেশকে কবজা করে নেয়। সব ক্ষেত্রে কানেকশনগুলো লুজ হয়ে যাওয়া কিংবা লুজ করে দেওয়ার কারণেই এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।
রাষ্ট্র ও সমাজের প্রায় সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জন্মের পর থেকে সৃষ্টি হওয়া বা সৃষ্টি করে আসা সেই লুজ কানেকশনগুলো মেরামতের ভার পড়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাঁধে। একটি অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থান এই কাজের ভার তাদের কাঁধে চাপিয়েছে। এই কাজে ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ যেমন তাদের নেই, তেমনি এই কাজ সম্পন্ন করাও মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ। অন্তর্বর্তী সরকার দৃশ্যত সেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে। কিন্তু রাজনীতির কূটকৌশল তা কতটা সফল হতে দেবে, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া কঠিন। কারণ কতগুলো লুজ কানেকশন খুবই স্পর্শকাতর। উদাহরণ হিসেবে রাষ্ট্রধর্মের কথা বলা যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত সংবিধান সংস্কার কমিশন এবং ওই কমিশন যাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় পরামর্শ সভায় বসেছে, তারা সংবিধানের অনেক সংস্কার, পরিবর্তনের কথা বলেছে। কিন্তু রাষ্ট্রধর্ম সম্পর্কে কেউ টুঁ শব্দটি করেছে বলে শুনিনি। তবে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে স্বীকৃত রেখে একটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক দেশ গঠন কীভাবে সম্ভব এই প্রশ্ন অনেকেই বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তুলে থাকেন। এই সমস্যার সমাধানও থাকতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার কার্যক্রমে। সেই কারণেই সব লুজ কানেকশনের সাফল্য নিয়ে অনিশ্চয়তা।
এই অনিশ্চয়তা কাটিয়েই অন্তর্বর্তী সরকারকে সফল হতে হবে।
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার একসময় ছিল আন্তর্জাতিক নৈতিকতার শীর্ষ সম্মান—যেখানে পুরস্কার পেতেন তাঁরা, যাঁদের জীবন ও কর্ম বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত। আজ সেই পুরস্কার অনেকটা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক সৌজন্য উপহার। যা দেওয়া হয় যখন কারও হাত মলতে হয়, অহংকারে তেল দিতে হয় বা নিজের অ্যাজেন্ডা...
১২ আগস্ট ২০২৫গত বছর জুলাই মাস থেকে আমাদের আন্দোলনকারী তরুণ ছাত্রছাত্রীদের মুখে ও কিছু কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মুখে, বেশি বেশি করে কয়েকটি বাক্য উচ্চারিত হয়ে আসছিল। বাকিগুলোর মধ্যে প্রথম যে বাক্যটি সবার কানে বেধেছে, সেটা হলো ‘বন্দোবস্ত’।
১২ আগস্ট ২০২৫প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন সম্প্রতি রংপুরে অনুষ্ঠিত এক সভায় যে কথাগুলো বলেছেন, তা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
১২ আগস্ট ২০২৫জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকার অবসানের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এ উপলক্ষে কয়েক দিন ধরে পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনের টক শোতে চলছে এক বছরের মূল্যায়ন।
১১ আগস্ট ২০২৫