মামুনুর রশীদ
অনেক দিন ধরে আমি একটা বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছি। আমার লেখায়, বিভিন্ন বক্তৃতায় এবং টক শোতে এই কথাটি বারবার বলেছি। পৃথিবীর অনেক দেশে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নেই। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড শিল্প-সাহিত্যের জন্য গড়ে ওঠা দলগুলোই করে থাকে। সরকার সেই দলগুলোকে আর্থিক সাহায্য দেয় মাত্র। কিন্তু তার বদলে কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে না। তবে দলগুলো যদি শৈল্পিক মান রক্ষা করতে না পারে, তাহলে তাকে আর পুনরায় আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয় না। অথবা তাকে আবারও গুণগত মান অর্জন করতে হয়। ইউরোপ, আমেরিকা এবং প্রাচ্যের জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং এসব দেশে এই ধরনের ব্যবস্থাই চালু আছে।
কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় শুধু আর্থিক সাহায্য নয়, আগে থেকেই নানান ধরনের শর্ত ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে থাকে। তার একটা বড় প্রমাণ হচ্ছে শিল্পকলা একাডেমি। শিল্পকলা একাডেমি একটি অনুষ্ঠান নির্মাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে থাকে। এবং তারই ভিত্তিতে প্রজেক্ট প্রণয়ন করে। এই প্রজেক্টগুলো শিল্পকলার কর্মকর্তারা তাঁদের দক্ষতা ও অদক্ষতা দিয়ে তৈরি করে থাকেন। ফলে সংস্কৃতি খাতে যে বরাদ্দটি আসে, তা শিল্পকলা একাডেমির শিল্প নির্মাণের খাতেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অন্যদিকে শত শত নাট্যদল, সংগীত ও নৃত্যের দল, চারুকলার শিল্পীরা নিজেরা অর্থ সংগ্রহ করে কায়ক্লেশে তাঁদের শিল্প নির্মাণ অব্যাহত রাখেন। শিল্পকলা একাডেমির যে শাখাগুলো
জেলায় বা উপজেলায় রয়েছে, তারাও একই কাজ করে থাকে। সেখানে আবার জেলা প্রশাসকেরা পদাধিকার বলে যেহেতু শিল্পকলা একাডেমির সভাপতি, তাই নিয়ন্ত্রণটা প্রশাসনের হাতেই চলে যায়।
এর মধ্যে যেটি সবচেয়ে ক্ষতিকর সেটি হচ্ছে, যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে তার কর্মসূচি এইসব অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। জেলা শহরগুলোতে বিষয়টি আরও সুনির্দিষ্ট। সেখানকার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তাদের পছন্দের লোকদের পৃষ্ঠপোষক করার মধ্য দিয়ে নিম্নমানের অনুষ্ঠান নির্মাণ করে থাকে। এসব কর্মকাণ্ডে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি। দেখা যায়, ক্ষমতার পালাবদলের পরপরই শিল্প-সাহিত্যের চেহারা পাল্টে গেছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একটি অনুদান দেওয়ার পদ্ধতি রয়েছে। এই অনুদান কমিটিতে সাধারণত দলীয় কর্মীরাই থাকেন, তাঁরা মন্ত্রী ও আমলাদের পরামর্শে ও নির্দেশে এই অনুদানের অর্থ বিলি করে থাকেন। সেই অর্থ খুবই নগণ্য। একটি নাটকের দলের মহড়াকক্ষ ভাড়া বা একটি নাট্য প্রযোজনা নামাতে যে পরিমাণ ব্যয় হয়, তার একটা ভগ্নাংশ এখান থেকে মেলে না। শুধু তা-ই নয়, অনেক ভুয়া সংগঠন এলাকার নেতার সুপারিশে অনুদান পেয়ে থাকে। শোনা যায় কিছু শিল্প-সাহিত্যের ব্যবসায়ী আছেন, যাঁরা নিজেরা কোনো শিল্প-সাহিত্যই করেন না, তাঁরা ভুয়া নাম দিয়ে অনেকগুলো অনুদান নিয়ে নেন। এই অনুদানটি একেবারেই মাঠে মারা যায়।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বাজেট যেমন ক্ষুদ্রাকৃতির, তেমনি এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যেসব মন্ত্রী-আমলা আসেন, তাঁরাও রাজনীতিতে তেমন উচ্চকণ্ঠ নন এবং দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে বাকি সবাই একেবারেই কোনো রকম অভিজ্ঞতা ছাড়া মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হয়ে বসেন। আর যাঁরা একটু অভিজ্ঞ তাঁরা সংস্কৃতির বিষয়টা নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামান না, আমলাদের তৈরি ফাইলে শুধু দস্তখত করেন। ভয়াবহ দিকটা হচ্ছে, ক্ষমতার শীর্ষে থাকা মানুষজনকে তুষ্ট করাই এদের কাজ। তাতে যদি কোটি কোটি টাকা ব্যয়ও হয় তাতে কোনো সমস্যা নেই। আরেকটি কাজে এই মন্ত্রণালয়ের এবং শিল্পকলা খুবই তৎপর থাকে, সেটি হচ্ছে বিদেশে সাংস্কৃতিক দল পাঠানোর বিষয়ে তাদের উৎসাহের অভাব নেই। শিল্পী যতই ভালো হোক, তাঁর ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি আনুগত্য লাগবেই। এখানেও বছরে কোটি টাকা খরচ হয়ে থাকে। কিন্তু বিদেশের মাটি থেকে তেমন কোনো সুনাম বয়ে আনার সংবাদ পাই না।
চারুকলার ক্ষেত্রে শিল্পকলা একাডেমি বেশ অর্থ ব্যয় করে থাকে। তবে সেগুলোর আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী যেমন দ্বিবার্ষিক একটি প্রদর্শনীর রেওয়াজ আছে শুধু সেখানে। কিন্তু দেশীয় শিল্পীদের বাজার সৃষ্টি করার জন্য বিভিন্ন গ্যালারিকে যে উৎসাহ প্রদান করা—সেসব ক্ষেত্রে তাদের কোনো ভূমিকা থাকে না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে রাষ্ট্রের অনুদান পাওয়ার ক্ষেত্রে যেকোনো শিল্পীর অধিকার থাকে। যদি সেই শিল্পীর ছবি বিক্রি না-ও হয়, অনুদানের অর্থে তাঁর খরচ উঠে যায়।
এখন বলি মূল কথা। সংস্কৃতিকে কি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায়? নাকি কোনো ধরনের দলীয় ধারণা থেকে শিল্প সৃষ্টি করা সম্ভব? বরং রাষ্ট্রের অন্যায়-অনাচার এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেকেই অনেক শিল্পের সৃষ্টি হয়েছে। জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের ছবি আমাদের অঙ্গ হয়ে গেছে। সেটি কি শিল্পী ছাড়া কোনো দলের প্রেরণা বা হস্তক্ষেপে হয়েছে? রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, নির্মলেন্দু গুণ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ এমনকি কিশোর কবি সুকান্ত—এঁরা কত কঠোর সংগ্রাম করে আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়েছেন! আজকের আধুনিক রাষ্ট্র এইসব শিল্পকর্মকে নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। এটা তাদের বদান্যতা নয়, এটা অধিকার। জনগণের অর্থে দেশ চলে আর সেই রাষ্ট্রে শিল্পীদের অধিকার থাকবে না?
কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকারের আমলা-মন্ত্রীদের আচরণ দেখে মনে হয় তাঁরা একেকজন মহানুভব, শিল্পীদের প্রতি বদান্যতা দেখাচ্ছেন। আসলে রাজনীতিবিদেরা বিভিন্ন কাজে এত ব্যস্ত থাকেন এবং আমলারা তাঁদের ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে যে সময় ব্যয় করেন, তাতে সংস্কৃতি নিয়ে ভাববার কোনো অবকাশ তাঁদের থাকে না। অথচ রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার, রাজনীতি—সবকিছুর মধ্যেই আছে সংস্কৃতি। যে সংস্কৃতি অপসংস্কৃতির গভীরে নিমজ্জিত মানুষ কোনো কল্যাণের, কোনো সুস্থ জীবনের স্বপ্ন পর্যন্ত দেখতে ভুলে গেছে। আর যার সূত্র হচ্ছে সংস্কৃতি। মানুষের প্রতিটি দিন যাপনের মধ্যে রয়েছে সংস্কৃতি চিন্তা। অথচ দেশের নীতিনির্ধারকেরা সংস্কৃতিকে ভাবেন শুধু গান, বাজনা, নাচ, অভিনয়। টেলিভিশন নাটককেই শুধু নাটক ভাবেন। মঞ্চনাটকের হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যের কোনো সংবাদ তাঁরা রাখেন না। উচ্চাঙ্গসংগীতের মূর্ছনায় মানুষের মন যে পাল্টে যায়, এটা তাঁরা ভাবতে পারেন না। মুখস্থ করে পাস করা আমলারা একটি কালজয়ী উপন্যাস পড়ে জগৎকে অন্যভাবে দেখবে, তার চেষ্টাও তাঁরা করেন না। সমাজকে বোঝার জন্য যে সাংস্কৃতিক মনমানসিকতা দরকার, যে চোখটি দরকার, তাকে ধরার চেষ্টাও তাঁরা করেন না। সংস্কৃতির বিষয়টা ছেড়ে দেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ওপর।
এই মন্ত্রণালয়ে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী আসতে চান না। কারণ, এখানে বাজেট কম। তাই তাঁদেরকে শিল্পীদের সঙ্গে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। যে আমলাটি শিল্পীদের সঙ্গে যান তিনি গিয়ে করুণার পাত্র হয়ে বসে থাকেন এবং পারডিয়েমের টাকা দিয়ে ঘোরাফেরা ও শপিংয়ের ধান্ধা করেন! বিদেশ ভ্রমণ থেকে আমলারা কিছু শেখেন না। তবে একটি বিষয় শেখেন, তা হলো কোন মার্কেটে কোন পণ্যটির দাম কম! এ জন্যই এই মন্ত্রণালয়টি যদি না থাকত তাহলে সঠিক জায়গাটি হতো শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কারণ, বহু আগে আমরা শুনেছি, নাটকে লোকশিক্ষা হয়। কাজেই নাটক শিক্ষার অংশ, চারুকলা, সংগীত, সাহিত্য এসবই আমাদের শিক্ষার অংশ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সেল এবং প্রভূত স্বায়ত্তশাসন দিয়ে শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি—এইসব প্রতিষ্ঠান দিয়ে যোগ্য শিল্পীদের মাধ্যমে সংস্কৃতিচর্চা সঠিকভাবে করা যেতে পারে।
কিন্তু সংবিধান থেকে ৭০ অনুচ্ছেদ যেমন ওঠানো যায় না, তেমনি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কেও ওঠানো যাবে না। বরং বাঙালি সংস্কৃতি এবং ৫০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতির অবক্ষয়ের কাজে এই মন্ত্রণালয়টি যুগের পর যুগ কাজ করে যাচ্ছে। বহমান নদীর মতো সংস্কৃতির যে অন্তঃসলিলা প্রভাবত্য, তাকে নিয়ন্ত্রণ করা মানে হলো আজকে আমাদের দেশে অতিরিক্ত বুদ্ধিমান প্রকৌশলীদের হাতে নদীগুলোকে ছেড়ে দেওয়া। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ যেভাবে বন্ধ করা হয়েছে, তেমনি সংস্কৃতির স্বাভাবিক প্রভাবও বন্ধ হলে তা শুধু অপসংস্কৃতিরই জন্ম হবে। আমরা কি সেই স্বপ্নের দিকে ধাবিত হব?
অনেক দিন ধরে আমি একটা বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছি। আমার লেখায়, বিভিন্ন বক্তৃতায় এবং টক শোতে এই কথাটি বারবার বলেছি। পৃথিবীর অনেক দেশে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় নেই। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড শিল্প-সাহিত্যের জন্য গড়ে ওঠা দলগুলোই করে থাকে। সরকার সেই দলগুলোকে আর্থিক সাহায্য দেয় মাত্র। কিন্তু তার বদলে কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে না। তবে দলগুলো যদি শৈল্পিক মান রক্ষা করতে না পারে, তাহলে তাকে আর পুনরায় আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয় না। অথবা তাকে আবারও গুণগত মান অর্জন করতে হয়। ইউরোপ, আমেরিকা এবং প্রাচ্যের জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং এসব দেশে এই ধরনের ব্যবস্থাই চালু আছে।
কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় শুধু আর্থিক সাহায্য নয়, আগে থেকেই নানান ধরনের শর্ত ও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে থাকে। তার একটা বড় প্রমাণ হচ্ছে শিল্পকলা একাডেমি। শিল্পকলা একাডেমি একটি অনুষ্ঠান নির্মাণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে থাকে। এবং তারই ভিত্তিতে প্রজেক্ট প্রণয়ন করে। এই প্রজেক্টগুলো শিল্পকলার কর্মকর্তারা তাঁদের দক্ষতা ও অদক্ষতা দিয়ে তৈরি করে থাকেন। ফলে সংস্কৃতি খাতে যে বরাদ্দটি আসে, তা শিল্পকলা একাডেমির শিল্প নির্মাণের খাতেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে। অন্যদিকে শত শত নাট্যদল, সংগীত ও নৃত্যের দল, চারুকলার শিল্পীরা নিজেরা অর্থ সংগ্রহ করে কায়ক্লেশে তাঁদের শিল্প নির্মাণ অব্যাহত রাখেন। শিল্পকলা একাডেমির যে শাখাগুলো
জেলায় বা উপজেলায় রয়েছে, তারাও একই কাজ করে থাকে। সেখানে আবার জেলা প্রশাসকেরা পদাধিকার বলে যেহেতু শিল্পকলা একাডেমির সভাপতি, তাই নিয়ন্ত্রণটা প্রশাসনের হাতেই চলে যায়।
এর মধ্যে যেটি সবচেয়ে ক্ষতিকর সেটি হচ্ছে, যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে তার কর্মসূচি এইসব অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। জেলা শহরগুলোতে বিষয়টি আরও সুনির্দিষ্ট। সেখানকার ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল তাদের পছন্দের লোকদের পৃষ্ঠপোষক করার মধ্য দিয়ে নিম্নমানের অনুষ্ঠান নির্মাণ করে থাকে। এসব কর্মকাণ্ডে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি। দেখা যায়, ক্ষমতার পালাবদলের পরপরই শিল্প-সাহিত্যের চেহারা পাল্টে গেছে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের একটি অনুদান দেওয়ার পদ্ধতি রয়েছে। এই অনুদান কমিটিতে সাধারণত দলীয় কর্মীরাই থাকেন, তাঁরা মন্ত্রী ও আমলাদের পরামর্শে ও নির্দেশে এই অনুদানের অর্থ বিলি করে থাকেন। সেই অর্থ খুবই নগণ্য। একটি নাটকের দলের মহড়াকক্ষ ভাড়া বা একটি নাট্য প্রযোজনা নামাতে যে পরিমাণ ব্যয় হয়, তার একটা ভগ্নাংশ এখান থেকে মেলে না। শুধু তা-ই নয়, অনেক ভুয়া সংগঠন এলাকার নেতার সুপারিশে অনুদান পেয়ে থাকে। শোনা যায় কিছু শিল্প-সাহিত্যের ব্যবসায়ী আছেন, যাঁরা নিজেরা কোনো শিল্প-সাহিত্যই করেন না, তাঁরা ভুয়া নাম দিয়ে অনেকগুলো অনুদান নিয়ে নেন। এই অনুদানটি একেবারেই মাঠে মারা যায়।
সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের বাজেট যেমন ক্ষুদ্রাকৃতির, তেমনি এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যেসব মন্ত্রী-আমলা আসেন, তাঁরাও রাজনীতিতে তেমন উচ্চকণ্ঠ নন এবং দু-একটি ব্যতিক্রম বাদে বাকি সবাই একেবারেই কোনো রকম অভিজ্ঞতা ছাড়া মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী হয়ে বসেন। আর যাঁরা একটু অভিজ্ঞ তাঁরা সংস্কৃতির বিষয়টা নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামান না, আমলাদের তৈরি ফাইলে শুধু দস্তখত করেন। ভয়াবহ দিকটা হচ্ছে, ক্ষমতার শীর্ষে থাকা মানুষজনকে তুষ্ট করাই এদের কাজ। তাতে যদি কোটি কোটি টাকা ব্যয়ও হয় তাতে কোনো সমস্যা নেই। আরেকটি কাজে এই মন্ত্রণালয়ের এবং শিল্পকলা খুবই তৎপর থাকে, সেটি হচ্ছে বিদেশে সাংস্কৃতিক দল পাঠানোর বিষয়ে তাদের উৎসাহের অভাব নেই। শিল্পী যতই ভালো হোক, তাঁর ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি আনুগত্য লাগবেই। এখানেও বছরে কোটি টাকা খরচ হয়ে থাকে। কিন্তু বিদেশের মাটি থেকে তেমন কোনো সুনাম বয়ে আনার সংবাদ পাই না।
চারুকলার ক্ষেত্রে শিল্পকলা একাডেমি বেশ অর্থ ব্যয় করে থাকে। তবে সেগুলোর আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী যেমন দ্বিবার্ষিক একটি প্রদর্শনীর রেওয়াজ আছে শুধু সেখানে। কিন্তু দেশীয় শিল্পীদের বাজার সৃষ্টি করার জন্য বিভিন্ন গ্যালারিকে যে উৎসাহ প্রদান করা—সেসব ক্ষেত্রে তাদের কোনো ভূমিকা থাকে না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে রাষ্ট্রের অনুদান পাওয়ার ক্ষেত্রে যেকোনো শিল্পীর অধিকার থাকে। যদি সেই শিল্পীর ছবি বিক্রি না-ও হয়, অনুদানের অর্থে তাঁর খরচ উঠে যায়।
এখন বলি মূল কথা। সংস্কৃতিকে কি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায়? নাকি কোনো ধরনের দলীয় ধারণা থেকে শিল্প সৃষ্টি করা সম্ভব? বরং রাষ্ট্রের অন্যায়-অনাচার এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ থেকেই অনেক শিল্পের সৃষ্টি হয়েছে। জয়নুল আবেদিনের দুর্ভিক্ষের ছবি আমাদের অঙ্গ হয়ে গেছে। সেটি কি শিল্পী ছাড়া কোনো দলের প্রেরণা বা হস্তক্ষেপে হয়েছে? রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, নির্মলেন্দু গুণ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ এমনকি কিশোর কবি সুকান্ত—এঁরা কত কঠোর সংগ্রাম করে আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়েছেন! আজকের আধুনিক রাষ্ট্র এইসব শিল্পকর্মকে নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকে। এটা তাদের বদান্যতা নয়, এটা অধিকার। জনগণের অর্থে দেশ চলে আর সেই রাষ্ট্রে শিল্পীদের অধিকার থাকবে না?
কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকারের আমলা-মন্ত্রীদের আচরণ দেখে মনে হয় তাঁরা একেকজন মহানুভব, শিল্পীদের প্রতি বদান্যতা দেখাচ্ছেন। আসলে রাজনীতিবিদেরা বিভিন্ন কাজে এত ব্যস্ত থাকেন এবং আমলারা তাঁদের ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে যে সময় ব্যয় করেন, তাতে সংস্কৃতি নিয়ে ভাববার কোনো অবকাশ তাঁদের থাকে না। অথচ রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার, রাজনীতি—সবকিছুর মধ্যেই আছে সংস্কৃতি। যে সংস্কৃতি অপসংস্কৃতির গভীরে নিমজ্জিত মানুষ কোনো কল্যাণের, কোনো সুস্থ জীবনের স্বপ্ন পর্যন্ত দেখতে ভুলে গেছে। আর যার সূত্র হচ্ছে সংস্কৃতি। মানুষের প্রতিটি দিন যাপনের মধ্যে রয়েছে সংস্কৃতি চিন্তা। অথচ দেশের নীতিনির্ধারকেরা সংস্কৃতিকে ভাবেন শুধু গান, বাজনা, নাচ, অভিনয়। টেলিভিশন নাটককেই শুধু নাটক ভাবেন। মঞ্চনাটকের হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যের কোনো সংবাদ তাঁরা রাখেন না। উচ্চাঙ্গসংগীতের মূর্ছনায় মানুষের মন যে পাল্টে যায়, এটা তাঁরা ভাবতে পারেন না। মুখস্থ করে পাস করা আমলারা একটি কালজয়ী উপন্যাস পড়ে জগৎকে অন্যভাবে দেখবে, তার চেষ্টাও তাঁরা করেন না। সমাজকে বোঝার জন্য যে সাংস্কৃতিক মনমানসিকতা দরকার, যে চোখটি দরকার, তাকে ধরার চেষ্টাও তাঁরা করেন না। সংস্কৃতির বিষয়টা ছেড়ে দেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ওপর।
এই মন্ত্রণালয়ে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী আসতে চান না। কারণ, এখানে বাজেট কম। তাই তাঁদেরকে শিল্পীদের সঙ্গে বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। যে আমলাটি শিল্পীদের সঙ্গে যান তিনি গিয়ে করুণার পাত্র হয়ে বসে থাকেন এবং পারডিয়েমের টাকা দিয়ে ঘোরাফেরা ও শপিংয়ের ধান্ধা করেন! বিদেশ ভ্রমণ থেকে আমলারা কিছু শেখেন না। তবে একটি বিষয় শেখেন, তা হলো কোন মার্কেটে কোন পণ্যটির দাম কম! এ জন্যই এই মন্ত্রণালয়টি যদি না থাকত তাহলে সঠিক জায়গাটি হতো শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কারণ, বহু আগে আমরা শুনেছি, নাটকে লোকশিক্ষা হয়। কাজেই নাটক শিক্ষার অংশ, চারুকলা, সংগীত, সাহিত্য এসবই আমাদের শিক্ষার অংশ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সেল এবং প্রভূত স্বায়ত্তশাসন দিয়ে শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি—এইসব প্রতিষ্ঠান দিয়ে যোগ্য শিল্পীদের মাধ্যমে সংস্কৃতিচর্চা সঠিকভাবে করা যেতে পারে।
কিন্তু সংবিধান থেকে ৭০ অনুচ্ছেদ যেমন ওঠানো যায় না, তেমনি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কেও ওঠানো যাবে না। বরং বাঙালি সংস্কৃতি এবং ৫০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংস্কৃতির অবক্ষয়ের কাজে এই মন্ত্রণালয়টি যুগের পর যুগ কাজ করে যাচ্ছে। বহমান নদীর মতো সংস্কৃতির যে অন্তঃসলিলা প্রভাবত্য, তাকে নিয়ন্ত্রণ করা মানে হলো আজকে আমাদের দেশে অতিরিক্ত বুদ্ধিমান প্রকৌশলীদের হাতে নদীগুলোকে ছেড়ে দেওয়া। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ যেভাবে বন্ধ করা হয়েছে, তেমনি সংস্কৃতির স্বাভাবিক প্রভাবও বন্ধ হলে তা শুধু অপসংস্কৃতিরই জন্ম হবে। আমরা কি সেই স্বপ্নের দিকে ধাবিত হব?
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার একসময় ছিল আন্তর্জাতিক নৈতিকতার শীর্ষ সম্মান—যেখানে পুরস্কার পেতেন তাঁরা, যাঁদের জীবন ও কর্ম বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত। আজ সেই পুরস্কার অনেকটা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক সৌজন্য উপহার। যা দেওয়া হয় যখন কারও হাত মলতে হয়, অহংকারে তেল দিতে হয় বা নিজের অ্যাজেন্ডা...
১২ আগস্ট ২০২৫গত বছর জুলাই মাস থেকে আমাদের আন্দোলনকারী তরুণ ছাত্রছাত্রীদের মুখে ও কিছু কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মুখে, বেশি বেশি করে কয়েকটি বাক্য উচ্চারিত হয়ে আসছিল। বাকিগুলোর মধ্যে প্রথম যে বাক্যটি সবার কানে বেধেছে, সেটা হলো ‘বন্দোবস্ত’।
১২ আগস্ট ২০২৫প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন সম্প্রতি রংপুরে অনুষ্ঠিত এক সভায় যে কথাগুলো বলেছেন, তা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
১২ আগস্ট ২০২৫জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকার অবসানের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এ উপলক্ষে কয়েক দিন ধরে পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনের টক শোতে চলছে এক বছরের মূল্যায়ন।
১১ আগস্ট ২০২৫