বিধান রিবেরু
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে চলমান যুদ্ধ-সংঘাত, দুরবস্থা, দ্বৈতনীতি, পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদির ভেতর বাংলাদেশ কেমন আছে? ফুটন্ত তেলের কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলা, আবার চুলা থেকে টগবগে কড়াই—এই তো চলছে এ দেশের জনগণকে নিয়ে। বরং যত দিন যাচ্ছে কড়াইয়ের তেল ও চুলার আগুন উভয়ই আরও উত্তপ্ত ও পরাবাস্তব হয়ে উঠছে। এখানে যা হচ্ছে তা দেখে আমাদের বিশ্বাস হতে চায় না যে আমরা একবিংশ শতকে রয়েছি। যে সময়ে মানুষ মঙ্গল গ্রহে দূরনিয়ন্ত্রিত গবেষণাগার-সমৃদ্ধ রোবোটিক বাহন পাঠিয়ে দিচ্ছে, ঠিক সে সময়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না আমরা কোন দিকে যাব। ডানে ঝুঁকব, না বামে, নাকি মাঝামাঝি স্থির থাকব? আমরা অবিরত দোলাচলে আছি মালিকানা নিয়ে। এই বাংলা কার, যাঁরা যুদ্ধ করে বাঙালিকে মুক্ত করেছিলেন, তাঁদের? নাকি যাঁরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরোধিতা শুধু নয়, যুদ্ধাপরাধের দোসর ছিলেন, তাদের?
মাঝামাঝি কোনো জিনিসই ভালো নয়। অন্তত কষ্টকর হলেও, এসপার-ওসপার একটা হয়ে যাওয়াটা অধিক স্বস্তির। তাতে আপনার যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। কিন্তু দেশে কী হচ্ছে? একদল শাহবাগে জাতীয় সংগীত গাওয়া যাবে না বলে ধমকাধমকি করছে। আরেক দল পরের দিন সমাবেশ ডেকে জাতীয় সংগীত গাওয়ার আয়োজন করছে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, যার ৫৪ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, সেখানে এখন পর্যন্ত কেন জাতীয় সংগীত নিয়ে দ্বিধা ও ঘৃণা প্রকাশ করতে দেখা যায়? তাহলে তারা কি বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে মানতে পারছে না? তারা কি তবে রাষ্ট্রদ্রোহী? বাংলাদেশ যদি আফগানিস্তানের মতো ধর্মীয় চরমপন্থার হাতে সমর্পিত হয় এবং আফগানিস্তানে যেমন সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বুদ্ধের মূর্তি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেভাবে যদি বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধারণ করা সবকিছুকেই উড়িয়ে দেওয়া হয় শতবর্ষী বটগাছ কেটে ফেলার মতো করে, তাতেও একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে দেশটা শেষ পর্যন্ত একটা দিকে গিয়ে দাঁড়াল। হোক সেটা চরমপন্থা ও অন্ধকারের আধার। অন্তত দেশটা কোন দিকে যাচ্ছে, কোন দিকে যাবে, এই চিন্তায়-চিন্তায় ঘুম ও শান্তি হারাম হতো না। এ যেন মুমূর্ষু রোগীর দশা, যে চির প্রস্থান নিচ্ছে না, কিন্তু স্বজনদের অসম্ভব মানসিক চাপের ভেতর রেখেছে। এমন মানসিক চাপের ভেতর স্বাভাবিক জীবনযাপন করা দুরূহ ব্যাপার। কেউ স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারছে না।
বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উল্টো দিকে প্রগতিশীল শক্তির একটা উপস্থিতি টের পাওয়া যায়, কিন্তু সেই শক্তি খুবই দুর্বল বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। মধ্যপন্থার শক্তিটি বড্ড সুবিধাবাদী। তারা ক্ষমতা যেদিকে, সেদিকেই ছাতা মেলে ধরে। এই সত্য প্রত্যেক বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের বেলায় সত্যি। মধ্যপন্থার শক্তি এই মুহূর্তে কিছুটা নিরপেক্ষতা বজায় রেখে চলছে, কোথাওবা তারা নিষ্ক্রিয়। আর ওদিকে বামপন্থী শক্তি প্রকৃতপক্ষে কোনো শক্তি হিসেবেই বাংলাদেশে দাঁড়াতে পারেনি, তাই তারা চরমপন্থার বিপরীতে কোনো বয়ান সৃষ্টি করতে পারছে না। আর এ কারণেই দেখা যায়, ধর্মীয় অরাজনৈতিক দলও রাজপথে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক মিছিল ও সমাবেশ করছে, কথায় কথায় সড়ক অবরোধ করছে। এর-তার নামে রাস্তাঘাটে গরু-ছাগল জবাই করে জিয়াফত করছে। দুঃখের বিষয়, এসব যারা করছে তাদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ ও কিশোর।
ধর্মীয় চরমপন্থা ছাড়াও কিশোরদের দেখা যাচ্ছে লেখাপড়া বাদ দিয়ে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শহরজুড়ে মারামারি করছে। এক কলেজের নামফলক আরেক কলেজের ছেলেরা খুলে নিয়ে যাচ্ছে। যেসব কিশোর লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি, তারা কিশোর গ্যাংয়ে যোগ দিয়ে রাজধানীর ভেতর প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে। দিনদুপুরে ছিনতাই, রাহাজানি, খুনোখুনি চালাচ্ছে। তুচ্ছ কারণে তারা আক্রোশে ফেটে পড়ছে। কদিন আগেই খবরে পড়লাম, টাকা চুরি করার সময় খালা দেখে ফেলেছে বলে এক কিশোর দুই খালাকে ছুরিকাঘাত করে খুন করে ফেলেছে!
নারী ও কন্যাশিশুদের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা তো মাঝে মহামারির মতো ছড়িয়ে গিয়েছিল। তনুর ধর্ষণ ও হত্যার বিচার তো হলোই না। নৃশংসভাবে সাগর-রুনিকে হত্যার বিচারও আর হবে কি না সন্দেহ রয়েছে! আরও শত শত উদাহরণ এনে জড়ো করা যায়, শেষ হবে না। এত অন্যায়, অনিয়ম, অবিচার! বাংলাদেশ জন্মের পর থেকেই চলছে, ক্রমেই বেড়েছে! তো এসব দেখে কি আপনার মনে হয় যে আপনি একটি সুস্থ ও সুন্দর বাস্তবতার ভেতর আছেন? আমার তো মনে হয়, আমরা ডিসটোপিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। এই দুঃসময় কবে শেষ হবে, সেটা কারও জানা নেই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই শাসকগোষ্ঠীর ভুলের পর ভুল পদক্ষেপ নেওয়ার খেসারত দিতে দিতে আজ আমরা এমন এক জায়গায় উপনীত হয়েছি, এমন এক রাষ্ট্র নির্মাণ করেছি, যেখানে নাগরিক অধিকার বলতে কিছু তো নেই-ই, নাগরিক সুবিধাও হয়ে উঠেছে সোনার হরিণ।
সামাজিক স্তরেই আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সৎ, নিষ্ঠাবান ও কর্মঠ মানুষ তৈরি করতে পারিনি। ছোটবেলা থেকেই লুটেরা মানসিকতা দিয়ে বড় করেছি শিশুদের। আমরা প্রাথমিক পরীক্ষায় পর্যন্ত নকল সরবরাহ করে শিশুদের নৈতিকতার ভিত্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছি। এটা উচ্চতর শিক্ষা পর্যন্ত কর্কট রোগের মতো বিস্তৃত হয়েছে। এখান থেকে ফিরে যাওয়ার পথ আর কারও জানা নেই। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা শুধু লোভ আর প্রতিহিংসার চাষাবাদ করেছি। এমনকি কোমলমতি শিশুদের মনস্তত্ত্বে আমরা জেনেবুঝে এসবের বীজ বপন করেছি—প্রতিবছর তাদের পাঠ্যবইতে অস্ত্রোপচার চালিয়ে বিদ্বেষের বিষ চালান করেছি। মাদ্রাসায় দিনরাত শেখানো হয়, বিধর্মীরা শত্রু!
ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের জের যেন এখনো আমাদের তাড়া করে ফিরছে। এ দেশের মানুষের মন এখন পর্যন্ত সেই গত শতকের সাম্প্রদায়িক চর্চার ভেতরেই বন্দী হয়ে আছে। নয়তো দেখবেন, চাকরিবাকরি থেকে শুরু করে মেলামেশা, এমনকি খাওয়াদাওয়া—সবকিছুতেই আমরা ধর্মীয় পরিচয়কে সর্বাগ্রে বিবেচনা করি। আমরা মানুষকে ধর্মের ঊর্ধ্বে ভাবতে পারছি না, অন্তত বেশির ভাগ মানুষ তা পারছে না। নয়তো ধর্মীয় পোশাক ও আচার নিয়ে যে অপ্রয়োজনীয় তর্ক আমাদের সমাজে চলে, তা হতো না। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যেভাবে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, সেটা হতো না।
ভাবতে অবাক লাগে, এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে বাইরে কিশোর-তরুণেরা যখন বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে নতুন নতুন আবিষ্কার, সাহিত্য-দর্শনে নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নিরীক্ষা করছেন, সেখানে আমরা দেখছি, আমাদের জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ, বিশেষ করে যাঁরা মাদ্রাসায় পড়েন বা পড়েছেন, তাঁরা তাঁদের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এবং নিজেদের যাপিত জীবনে এমন সব বিষয় নিয়ে পড়ে আছেন, যার সঙ্গে প্রগতিশীলতার কোনো যোগ নেই। শুধু মাদ্রাসাশিক্ষার্থী কেন, সাধারণ স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও কি খুব একটা এগোতে পারছে প্রগতিশীল চিন্তার ক্ষেত্রে? তারাও কি কূপমণ্ডূকতার ভেতর নিমজ্জিত হচ্ছে না? এমন পরিস্থিতি তো আমরাই তৈরি করেছি ধীরে ধীরে। আমাদের শাসক ও এলিট গোষ্ঠী পরিকল্পনা করেই এমন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করেছে।
স্বৈরাচারী সরকারগুলো দিনের পর দিন রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে প্রতিপালন শুধু নয়, উৎসাহিত করে গেছে। সংবিধান পরিবর্তন ও সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবারে আনা থেকে শুরু করে জেলায় জেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণ করা—কোনো কিছুই বাদ রাখেনি শাসকগোষ্ঠী। অথচ রাষ্ট্রকে হতে হয় ধর্মনিরপেক্ষ। রাষ্ট্রের ধর্ম থাকতে পারে না। কিন্তু এই নীতিতে কোনো শাসকই আস্থা রাখেনি। তারা ধর্মকে ব্যবহার করে গেছে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য। যুগ যুগ ধরে ধর্মকে এভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোশকতাদানের পেছনে যে ভোটের রাজনীতি রয়েছে, তা সবাই বোঝেন। আর সেটা করতে গিয়ে এখন ভোটের রাজনীতিকেই উল্টো নিয়ন্ত্রণ করতে চলেছে ধর্ম বা ধর্মীয় মতাদর্শের রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী। তাই তারা রাষ্ট্রের নাম পাল্টে ফেলতে চায়, রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত বাতিল করতে চায়, এমনকি মানুষের পোশাক-আশাকও ধর্মানুসারে বেঁধে দিতে চায়।
যেমন বীজ বপন করবেন, আপনার ফলনও তেমন হবে। আজকের বাংলাদেশে যে চরমপন্থার উত্থান আমরা দেখছি, সেটির বীজ এই ছদ্মবেশী প্রগতিশীল শাসকগোষ্ঠীরাই বপন করেছে। এর খেসারত সবাইকেই দিতে হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে চলমান যুদ্ধ-সংঘাত, দুরবস্থা, দ্বৈতনীতি, পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদির ভেতর বাংলাদেশ কেমন আছে? ফুটন্ত তেলের কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলা, আবার চুলা থেকে টগবগে কড়াই—এই তো চলছে এ দেশের জনগণকে নিয়ে। বরং যত দিন যাচ্ছে কড়াইয়ের তেল ও চুলার আগুন উভয়ই আরও উত্তপ্ত ও পরাবাস্তব হয়ে উঠছে। এখানে যা হচ্ছে তা দেখে আমাদের বিশ্বাস হতে চায় না যে আমরা একবিংশ শতকে রয়েছি। যে সময়ে মানুষ মঙ্গল গ্রহে দূরনিয়ন্ত্রিত গবেষণাগার-সমৃদ্ধ রোবোটিক বাহন পাঠিয়ে দিচ্ছে, ঠিক সে সময়ে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না আমরা কোন দিকে যাব। ডানে ঝুঁকব, না বামে, নাকি মাঝামাঝি স্থির থাকব? আমরা অবিরত দোলাচলে আছি মালিকানা নিয়ে। এই বাংলা কার, যাঁরা যুদ্ধ করে বাঙালিকে মুক্ত করেছিলেন, তাঁদের? নাকি যাঁরা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরোধিতা শুধু নয়, যুদ্ধাপরাধের দোসর ছিলেন, তাদের?
মাঝামাঝি কোনো জিনিসই ভালো নয়। অন্তত কষ্টকর হলেও, এসপার-ওসপার একটা হয়ে যাওয়াটা অধিক স্বস্তির। তাতে আপনার যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হবে। কিন্তু দেশে কী হচ্ছে? একদল শাহবাগে জাতীয় সংগীত গাওয়া যাবে না বলে ধমকাধমকি করছে। আরেক দল পরের দিন সমাবেশ ডেকে জাতীয় সংগীত গাওয়ার আয়োজন করছে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, যার ৫৪ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে, সেখানে এখন পর্যন্ত কেন জাতীয় সংগীত নিয়ে দ্বিধা ও ঘৃণা প্রকাশ করতে দেখা যায়? তাহলে তারা কি বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে মানতে পারছে না? তারা কি তবে রাষ্ট্রদ্রোহী? বাংলাদেশ যদি আফগানিস্তানের মতো ধর্মীয় চরমপন্থার হাতে সমর্পিত হয় এবং আফগানিস্তানে যেমন সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী বুদ্ধের মূর্তি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, সেভাবে যদি বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধারণ করা সবকিছুকেই উড়িয়ে দেওয়া হয় শতবর্ষী বটগাছ কেটে ফেলার মতো করে, তাতেও একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে দেশটা শেষ পর্যন্ত একটা দিকে গিয়ে দাঁড়াল। হোক সেটা চরমপন্থা ও অন্ধকারের আধার। অন্তত দেশটা কোন দিকে যাচ্ছে, কোন দিকে যাবে, এই চিন্তায়-চিন্তায় ঘুম ও শান্তি হারাম হতো না। এ যেন মুমূর্ষু রোগীর দশা, যে চির প্রস্থান নিচ্ছে না, কিন্তু স্বজনদের অসম্ভব মানসিক চাপের ভেতর রেখেছে। এমন মানসিক চাপের ভেতর স্বাভাবিক জীবনযাপন করা দুরূহ ব্যাপার। কেউ স্বস্তির নিশ্বাস নিতে পারছে না।
বাংলাদেশে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির উল্টো দিকে প্রগতিশীল শক্তির একটা উপস্থিতি টের পাওয়া যায়, কিন্তু সেই শক্তি খুবই দুর্বল বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। মধ্যপন্থার শক্তিটি বড্ড সুবিধাবাদী। তারা ক্ষমতা যেদিকে, সেদিকেই ছাতা মেলে ধরে। এই সত্য প্রত্যেক বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলের বেলায় সত্যি। মধ্যপন্থার শক্তি এই মুহূর্তে কিছুটা নিরপেক্ষতা বজায় রেখে চলছে, কোথাওবা তারা নিষ্ক্রিয়। আর ওদিকে বামপন্থী শক্তি প্রকৃতপক্ষে কোনো শক্তি হিসেবেই বাংলাদেশে দাঁড়াতে পারেনি, তাই তারা চরমপন্থার বিপরীতে কোনো বয়ান সৃষ্টি করতে পারছে না। আর এ কারণেই দেখা যায়, ধর্মীয় অরাজনৈতিক দলও রাজপথে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক মিছিল ও সমাবেশ করছে, কথায় কথায় সড়ক অবরোধ করছে। এর-তার নামে রাস্তাঘাটে গরু-ছাগল জবাই করে জিয়াফত করছে। দুঃখের বিষয়, এসব যারা করছে তাদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ ও কিশোর।
ধর্মীয় চরমপন্থা ছাড়াও কিশোরদের দেখা যাচ্ছে লেখাপড়া বাদ দিয়ে তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে শহরজুড়ে মারামারি করছে। এক কলেজের নামফলক আরেক কলেজের ছেলেরা খুলে নিয়ে যাচ্ছে। যেসব কিশোর লেখাপড়ার সুযোগ পায়নি, তারা কিশোর গ্যাংয়ে যোগ দিয়ে রাজধানীর ভেতর প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে। দিনদুপুরে ছিনতাই, রাহাজানি, খুনোখুনি চালাচ্ছে। তুচ্ছ কারণে তারা আক্রোশে ফেটে পড়ছে। কদিন আগেই খবরে পড়লাম, টাকা চুরি করার সময় খালা দেখে ফেলেছে বলে এক কিশোর দুই খালাকে ছুরিকাঘাত করে খুন করে ফেলেছে!
নারী ও কন্যাশিশুদের ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা তো মাঝে মহামারির মতো ছড়িয়ে গিয়েছিল। তনুর ধর্ষণ ও হত্যার বিচার তো হলোই না। নৃশংসভাবে সাগর-রুনিকে হত্যার বিচারও আর হবে কি না সন্দেহ রয়েছে! আরও শত শত উদাহরণ এনে জড়ো করা যায়, শেষ হবে না। এত অন্যায়, অনিয়ম, অবিচার! বাংলাদেশ জন্মের পর থেকেই চলছে, ক্রমেই বেড়েছে! তো এসব দেখে কি আপনার মনে হয় যে আপনি একটি সুস্থ ও সুন্দর বাস্তবতার ভেতর আছেন? আমার তো মনে হয়, আমরা ডিসটোপিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। এই দুঃসময় কবে শেষ হবে, সেটা কারও জানা নেই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই শাসকগোষ্ঠীর ভুলের পর ভুল পদক্ষেপ নেওয়ার খেসারত দিতে দিতে আজ আমরা এমন এক জায়গায় উপনীত হয়েছি, এমন এক রাষ্ট্র নির্মাণ করেছি, যেখানে নাগরিক অধিকার বলতে কিছু তো নেই-ই, নাগরিক সুবিধাও হয়ে উঠেছে সোনার হরিণ।
সামাজিক স্তরেই আমরা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সৎ, নিষ্ঠাবান ও কর্মঠ মানুষ তৈরি করতে পারিনি। ছোটবেলা থেকেই লুটেরা মানসিকতা দিয়ে বড় করেছি শিশুদের। আমরা প্রাথমিক পরীক্ষায় পর্যন্ত নকল সরবরাহ করে শিশুদের নৈতিকতার ভিত্তিকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছি। এটা উচ্চতর শিক্ষা পর্যন্ত কর্কট রোগের মতো বিস্তৃত হয়েছে। এখান থেকে ফিরে যাওয়ার পথ আর কারও জানা নেই। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা শুধু লোভ আর প্রতিহিংসার চাষাবাদ করেছি। এমনকি কোমলমতি শিশুদের মনস্তত্ত্বে আমরা জেনেবুঝে এসবের বীজ বপন করেছি—প্রতিবছর তাদের পাঠ্যবইতে অস্ত্রোপচার চালিয়ে বিদ্বেষের বিষ চালান করেছি। মাদ্রাসায় দিনরাত শেখানো হয়, বিধর্মীরা শত্রু!
ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের জের যেন এখনো আমাদের তাড়া করে ফিরছে। এ দেশের মানুষের মন এখন পর্যন্ত সেই গত শতকের সাম্প্রদায়িক চর্চার ভেতরেই বন্দী হয়ে আছে। নয়তো দেখবেন, চাকরিবাকরি থেকে শুরু করে মেলামেশা, এমনকি খাওয়াদাওয়া—সবকিছুতেই আমরা ধর্মীয় পরিচয়কে সর্বাগ্রে বিবেচনা করি। আমরা মানুষকে ধর্মের ঊর্ধ্বে ভাবতে পারছি না, অন্তত বেশির ভাগ মানুষ তা পারছে না। নয়তো ধর্মীয় পোশাক ও আচার নিয়ে যে অপ্রয়োজনীয় তর্ক আমাদের সমাজে চলে, তা হতো না। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যেভাবে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, সেটা হতো না।
ভাবতে অবাক লাগে, এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে বাইরে কিশোর-তরুণেরা যখন বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে নতুন নতুন আবিষ্কার, সাহিত্য-দর্শনে নতুন নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নিরীক্ষা করছেন, সেখানে আমরা দেখছি, আমাদের জনগোষ্ঠীর একটি বিশাল অংশ, বিশেষ করে যাঁরা মাদ্রাসায় পড়েন বা পড়েছেন, তাঁরা তাঁদের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এবং নিজেদের যাপিত জীবনে এমন সব বিষয় নিয়ে পড়ে আছেন, যার সঙ্গে প্রগতিশীলতার কোনো যোগ নেই। শুধু মাদ্রাসাশিক্ষার্থী কেন, সাধারণ স্কুল-কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও কি খুব একটা এগোতে পারছে প্রগতিশীল চিন্তার ক্ষেত্রে? তারাও কি কূপমণ্ডূকতার ভেতর নিমজ্জিত হচ্ছে না? এমন পরিস্থিতি তো আমরাই তৈরি করেছি ধীরে ধীরে। আমাদের শাসক ও এলিট গোষ্ঠী পরিকল্পনা করেই এমন সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করেছে।
স্বৈরাচারী সরকারগুলো দিনের পর দিন রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি নির্দিষ্ট ধর্মকে প্রতিপালন শুধু নয়, উৎসাহিত করে গেছে। সংবিধান পরিবর্তন ও সাপ্তাহিক ছুটি শুক্রবারে আনা থেকে শুরু করে জেলায় জেলায় মডেল মসজিদ নির্মাণ করা—কোনো কিছুই বাদ রাখেনি শাসকগোষ্ঠী। অথচ রাষ্ট্রকে হতে হয় ধর্মনিরপেক্ষ। রাষ্ট্রের ধর্ম থাকতে পারে না। কিন্তু এই নীতিতে কোনো শাসকই আস্থা রাখেনি। তারা ধর্মকে ব্যবহার করে গেছে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার জন্য। যুগ যুগ ধরে ধর্মকে এভাবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোশকতাদানের পেছনে যে ভোটের রাজনীতি রয়েছে, তা সবাই বোঝেন। আর সেটা করতে গিয়ে এখন ভোটের রাজনীতিকেই উল্টো নিয়ন্ত্রণ করতে চলেছে ধর্ম বা ধর্মীয় মতাদর্শের রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী। তাই তারা রাষ্ট্রের নাম পাল্টে ফেলতে চায়, রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত বাতিল করতে চায়, এমনকি মানুষের পোশাক-আশাকও ধর্মানুসারে বেঁধে দিতে চায়।
যেমন বীজ বপন করবেন, আপনার ফলনও তেমন হবে। আজকের বাংলাদেশে যে চরমপন্থার উত্থান আমরা দেখছি, সেটির বীজ এই ছদ্মবেশী প্রগতিশীল শাসকগোষ্ঠীরাই বপন করেছে। এর খেসারত সবাইকেই দিতে হবে।
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার একসময় ছিল আন্তর্জাতিক নৈতিকতার শীর্ষ সম্মান—যেখানে পুরস্কার পেতেন তাঁরা, যাঁদের জীবন ও কর্ম বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত। আজ সেই পুরস্কার অনেকটা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক সৌজন্য উপহার। যা দেওয়া হয় যখন কারও হাত মলতে হয়, অহংকারে তেল দিতে হয় বা নিজের অ্যাজেন্ডা...
১২ আগস্ট ২০২৫গত বছর জুলাই মাস থেকে আমাদের আন্দোলনকারী তরুণ ছাত্রছাত্রীদের মুখে ও কিছু কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মুখে, বেশি বেশি করে কয়েকটি বাক্য উচ্চারিত হয়ে আসছিল। বাকিগুলোর মধ্যে প্রথম যে বাক্যটি সবার কানে বেধেছে, সেটা হলো ‘বন্দোবস্ত’।
১২ আগস্ট ২০২৫প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন সম্প্রতি রংপুরে অনুষ্ঠিত এক সভায় যে কথাগুলো বলেছেন, তা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
১২ আগস্ট ২০২৫জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকার অবসানের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এ উপলক্ষে কয়েক দিন ধরে পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনের টক শোতে চলছে এক বছরের মূল্যায়ন।
১১ আগস্ট ২০২৫