রাজীব কুমার সাহা
বাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘কলকে পাওয়া’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই বাগধারা হিসেবে শব্দবন্ধটির প্রয়োগ করে থাকি। বাংলা অভিধানে কলকে শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে। কিন্তু এই কলকে শব্দের অর্থ কী? আবার কলকে পাওয়া শব্দবন্ধ দিয়ে কী বোঝায়? এটি পেলেইবা কী হয়? আর এর আক্ষরিক এবং আলংকারিক অর্থইবা কী? তবে চলুন আজ জানব কলকে পাওয়ার সাতসতেরো।
হিন্দি শব্দ কলকে এবং পাওয়া শব্দসহযোগে কলকে পাওয়া বাগধারাটি গঠিত হয়েছে। এটি ক্রিয়াপদ। কলকে শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো ধূমপানের জন্য ব্যবহৃত ছিদ্রযুক্ত মাটির পাত্রবিশেষ (যাতে তামাক ভরে তার ওপরে জ্বলন্ত টিকা রাখা হয়), হুঁকার কলকে; এক কলকে পরিমাণ (তামাক বা গাঁজা)। কলকে শব্দের আরেকটি অর্থ হলো উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে জাত এবং সারা বছর ফোটে এমন বিষাক্ত বীজবিশিষ্ট ঘণ্টাকৃতি হলুদ ফুল। কলকে পাওয়া বাগধারায় উল্লিখিত কলকে শব্দের প্রথম অর্থটির আলংকারিক প্রয়োগকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কলকে পাওয়া বাগধারার মূল অর্থ হলো সম্মান বা মর্যাদা পাওয়া, যত্ন-আত্তি পাওয়া, তথা বিশেষ কোনো আয়োজনে গুরুত্ব পাওয়া।
হুঁকার সঙ্গে রয়েছে কলকের নিবিড় সম্পর্ক। হুঁকো, হুঁকা, হুক্কা প্রভৃতি বিভিন্ন নামেই তামাক সেবনের এই সরঞ্জামটি পরিচিত। আরবি শব্দ হুক্কার অপভ্রংশ রূপ হুঁকা শব্দটি বাংলাসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন ভাষায় প্রচলিত রয়েছে। হুঁকা হলো কলকেয় রাখা। জ্বলন্ত তামাকে ধোঁয়া (ধাতব পাত্রের সঞ্চিত জলের মধ্য দিয়ে শোধিত) সেবনের জন্য ব্যবহৃত দীর্ঘ নলযুক্ত সরঞ্জাম, যা আলবোলা বা ফরসি নামেও পরিচিত।
মুঘল আমলে ভারতীয় উপমহাদেশে অবস্থানরত ইংরেজ ও অন্য ইউরোপীয়রা হুঁকাকে সম্বোধন করত ‘হাবল-বাবল’ নামে। যদিও সরঞ্জামটির প্রায়োগিক দিক বিবেচনায়ই এ নামকরণ করা হয়েছে। কেননা তামাক সেবনের সময় হুঁকা থেকে বুদ্বুদ শব্দে ধোঁয়া নির্গত হয়। উচ্চ, অভিজাত শ্রেণিকর্তৃক ব্যবহৃত হুঁকাকে বলা হয় ফরসি। এটির নিচের অংশের গঠনাকৃতি অন্যান্য হুঁকার চেয়ে ভিন্ন ও বিচিত্র। সাধারণ হুঁকায় যে ধরনের ছিদ্র থাকে, ফরসি হুঁকায় তার বদলে থাকে একটি পাইপ বা নল। ফরসি হুঁকার গায়ে ও ছিলিম পাত্রে নানা কারুকার্য খচিত থাকত। রাজকীয় ব্যক্তি, জমিদার, অভিজাত ও বিত্তবান শ্রেণির হুঁকা বহুবিচিত্র কারুকার্যে থাকত নকশামণ্ডিত।
একসময় ব্রিটিশ ভারতে হুঁকার মাধ্যমে ধূমপান ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ছিল হুঁকার ব্যবহার। হুঁকা তৈরির জন্য একটি সম্প্রদায়ই গড়ে উঠেছিল। সচরাচর নারকেলের খোল দিয়ে তৈরি হতো হুঁকা। বিশেষ কায়দায় খোল থেকে বের করে নেওয়া হতো শাঁস। তারপর নারকেলের খোলে কালো রং ধারণ করার আগ পর্যন্ত চলত তাপপ্রয়োগ। আগুনে পুড়িয়ে শিক খোলের মাঝখানে চেপে ধরলেই হতো গোল ছিদ্র। খোলের মুখে বসানো হতো কাঠের নলচে। নলচের ভেতর দিয়েও থাকত আরেকটি গোল ছিদ্র। তার মাথায় লাগানো হতো মাটির কলকি। ছিলিম বা কলকি হচ্ছে একটি ফাঁপা কৌণিক ছোট পাত্র, যাতে ধূমপানের জন্য প্রস্তুতকৃত তামাক ও জ্বলন্ত কাঠকয়লা পুরে দেওয়া হতো। ছিলিম বলতে একই সঙ্গে ধূমপানের তামাক ও তার আধারকে বোঝায়। হুঁকায় ব্যবহারের জন্য তামাক পাতাকে কেটে গুঁড়া করা হয় এবং ঝোলাগুড় বা চিটাগুড়ের সঙ্গে ভালোভাবে মাখিয়ে তামাক প্রস্তুত হতো। তার আগে খোলের ভেতর দেওয়া হতো পরিমাণমতো পানি। এরপর তামাকে আগুন দিয়ে খোলের মাঝখানের ছিদ্রে টান দিলেই বের হতো ধোঁয়া।
প্রথা অনুসারে কোনো অনুষ্ঠানে সম্মানীয় অতিথিকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করে নেওয়া অন্যতম সামাজিক মর্যাদার পরিচায়ক। কিন্তু অতীতকালে এ রীতি ছিল ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন মর্যাদায়। তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় আমন্ত্রিত অতিথিকে তামাকশোভিত হুঁকা দিয়ে স্বাগত জানানো হতো। তামাক বা হুঁকা এগিয়ে দিয়ে বরণ করা ছিল সম্মান ও মর্যাদার অনন্য প্রতীক। তবে আমন্ত্রিত অতিথির সবাই কিন্তু কলকে পেত না। কেবল বিশিষ্ট অতিথিরাই সম্মানের স্বীকৃতিস্বরূপ কলকে পেতেন। মূলত মর্যাদার চিহ্নস্বরূপ এই কলকে পাওয়ার বিষয়টিই কালের পরিক্রমায় বাগধারার মাধ্যমে আমাদের ভাষায় স্থান করে নিয়েছে। আমাদের বাংলা ভাষাভাষী সমাজে কলকে পাওয়ার মতো এমন বহু শব্দ ইতিমধ্যে তার আক্ষরিক অর্থ ছাপিয়ে আলংকারিক ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত হয়েছে।
লেখক: আভিধানিক ও প্রাবন্ধিক
বাংলা ভাষায় অতিপরিচিত একটি শব্দবন্ধ হলো ‘কলকে পাওয়া’। যাপিত জীবনে কমবেশি আমরা সবাই বাগধারা হিসেবে শব্দবন্ধটির প্রয়োগ করে থাকি। বাংলা অভিধানে কলকে শব্দের একাধিক অর্থ রয়েছে। কিন্তু এই কলকে শব্দের অর্থ কী? আবার কলকে পাওয়া শব্দবন্ধ দিয়ে কী বোঝায়? এটি পেলেইবা কী হয়? আর এর আক্ষরিক এবং আলংকারিক অর্থইবা কী? তবে চলুন আজ জানব কলকে পাওয়ার সাতসতেরো।
হিন্দি শব্দ কলকে এবং পাওয়া শব্দসহযোগে কলকে পাওয়া বাগধারাটি গঠিত হয়েছে। এটি ক্রিয়াপদ। কলকে শব্দের আক্ষরিক অর্থ হলো ধূমপানের জন্য ব্যবহৃত ছিদ্রযুক্ত মাটির পাত্রবিশেষ (যাতে তামাক ভরে তার ওপরে জ্বলন্ত টিকা রাখা হয়), হুঁকার কলকে; এক কলকে পরিমাণ (তামাক বা গাঁজা)। কলকে শব্দের আরেকটি অর্থ হলো উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে জাত এবং সারা বছর ফোটে এমন বিষাক্ত বীজবিশিষ্ট ঘণ্টাকৃতি হলুদ ফুল। কলকে পাওয়া বাগধারায় উল্লিখিত কলকে শব্দের প্রথম অর্থটির আলংকারিক প্রয়োগকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কলকে পাওয়া বাগধারার মূল অর্থ হলো সম্মান বা মর্যাদা পাওয়া, যত্ন-আত্তি পাওয়া, তথা বিশেষ কোনো আয়োজনে গুরুত্ব পাওয়া।
হুঁকার সঙ্গে রয়েছে কলকের নিবিড় সম্পর্ক। হুঁকো, হুঁকা, হুক্কা প্রভৃতি বিভিন্ন নামেই তামাক সেবনের এই সরঞ্জামটি পরিচিত। আরবি শব্দ হুক্কার অপভ্রংশ রূপ হুঁকা শব্দটি বাংলাসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন ভাষায় প্রচলিত রয়েছে। হুঁকা হলো কলকেয় রাখা। জ্বলন্ত তামাকে ধোঁয়া (ধাতব পাত্রের সঞ্চিত জলের মধ্য দিয়ে শোধিত) সেবনের জন্য ব্যবহৃত দীর্ঘ নলযুক্ত সরঞ্জাম, যা আলবোলা বা ফরসি নামেও পরিচিত।
মুঘল আমলে ভারতীয় উপমহাদেশে অবস্থানরত ইংরেজ ও অন্য ইউরোপীয়রা হুঁকাকে সম্বোধন করত ‘হাবল-বাবল’ নামে। যদিও সরঞ্জামটির প্রায়োগিক দিক বিবেচনায়ই এ নামকরণ করা হয়েছে। কেননা তামাক সেবনের সময় হুঁকা থেকে বুদ্বুদ শব্দে ধোঁয়া নির্গত হয়। উচ্চ, অভিজাত শ্রেণিকর্তৃক ব্যবহৃত হুঁকাকে বলা হয় ফরসি। এটির নিচের অংশের গঠনাকৃতি অন্যান্য হুঁকার চেয়ে ভিন্ন ও বিচিত্র। সাধারণ হুঁকায় যে ধরনের ছিদ্র থাকে, ফরসি হুঁকায় তার বদলে থাকে একটি পাইপ বা নল। ফরসি হুঁকার গায়ে ও ছিলিম পাত্রে নানা কারুকার্য খচিত থাকত। রাজকীয় ব্যক্তি, জমিদার, অভিজাত ও বিত্তবান শ্রেণির হুঁকা বহুবিচিত্র কারুকার্যে থাকত নকশামণ্ডিত।
একসময় ব্রিটিশ ভারতে হুঁকার মাধ্যমে ধূমপান ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে ছিল হুঁকার ব্যবহার। হুঁকা তৈরির জন্য একটি সম্প্রদায়ই গড়ে উঠেছিল। সচরাচর নারকেলের খোল দিয়ে তৈরি হতো হুঁকা। বিশেষ কায়দায় খোল থেকে বের করে নেওয়া হতো শাঁস। তারপর নারকেলের খোলে কালো রং ধারণ করার আগ পর্যন্ত চলত তাপপ্রয়োগ। আগুনে পুড়িয়ে শিক খোলের মাঝখানে চেপে ধরলেই হতো গোল ছিদ্র। খোলের মুখে বসানো হতো কাঠের নলচে। নলচের ভেতর দিয়েও থাকত আরেকটি গোল ছিদ্র। তার মাথায় লাগানো হতো মাটির কলকি। ছিলিম বা কলকি হচ্ছে একটি ফাঁপা কৌণিক ছোট পাত্র, যাতে ধূমপানের জন্য প্রস্তুতকৃত তামাক ও জ্বলন্ত কাঠকয়লা পুরে দেওয়া হতো। ছিলিম বলতে একই সঙ্গে ধূমপানের তামাক ও তার আধারকে বোঝায়। হুঁকায় ব্যবহারের জন্য তামাক পাতাকে কেটে গুঁড়া করা হয় এবং ঝোলাগুড় বা চিটাগুড়ের সঙ্গে ভালোভাবে মাখিয়ে তামাক প্রস্তুত হতো। তার আগে খোলের ভেতর দেওয়া হতো পরিমাণমতো পানি। এরপর তামাকে আগুন দিয়ে খোলের মাঝখানের ছিদ্রে টান দিলেই বের হতো ধোঁয়া।
প্রথা অনুসারে কোনো অনুষ্ঠানে সম্মানীয় অতিথিকে ফুলের তোড়া দিয়ে বরণ করে নেওয়া অন্যতম সামাজিক মর্যাদার পরিচায়ক। কিন্তু অতীতকালে এ রীতি ছিল ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন মর্যাদায়। তৎকালীন সমাজব্যবস্থায় আমন্ত্রিত অতিথিকে তামাকশোভিত হুঁকা দিয়ে স্বাগত জানানো হতো। তামাক বা হুঁকা এগিয়ে দিয়ে বরণ করা ছিল সম্মান ও মর্যাদার অনন্য প্রতীক। তবে আমন্ত্রিত অতিথির সবাই কিন্তু কলকে পেত না। কেবল বিশিষ্ট অতিথিরাই সম্মানের স্বীকৃতিস্বরূপ কলকে পেতেন। মূলত মর্যাদার চিহ্নস্বরূপ এই কলকে পাওয়ার বিষয়টিই কালের পরিক্রমায় বাগধারার মাধ্যমে আমাদের ভাষায় স্থান করে নিয়েছে। আমাদের বাংলা ভাষাভাষী সমাজে কলকে পাওয়ার মতো এমন বহু শব্দ ইতিমধ্যে তার আক্ষরিক অর্থ ছাপিয়ে আলংকারিক ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত হয়েছে।
লেখক: আভিধানিক ও প্রাবন্ধিক
শান্তিতে নোবেল পুরস্কার একসময় ছিল আন্তর্জাতিক নৈতিকতার শীর্ষ সম্মান—যেখানে পুরস্কার পেতেন তাঁরা, যাঁদের জীবন ও কর্ম বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত। আজ সেই পুরস্কার অনেকটা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক সৌজন্য উপহার। যা দেওয়া হয় যখন কারও হাত মলতে হয়, অহংকারে তেল দিতে হয় বা নিজের অ্যাজেন্ডা...
১২ আগস্ট ২০২৫গত বছর জুলাই মাস থেকে আমাদের আন্দোলনকারী তরুণ ছাত্রছাত্রীদের মুখে ও কিছু কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মুখে, বেশি বেশি করে কয়েকটি বাক্য উচ্চারিত হয়ে আসছিল। বাকিগুলোর মধ্যে প্রথম যে বাক্যটি সবার কানে বেধেছে, সেটা হলো ‘বন্দোবস্ত’।
১২ আগস্ট ২০২৫প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন সম্প্রতি রংপুরে অনুষ্ঠিত এক সভায় যে কথাগুলো বলেছেন, তা দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি অকপটে স্বীকার করেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা এখন নির্বাচন কমিশনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
১২ আগস্ট ২০২৫জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকার অবসানের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। এ উপলক্ষে কয়েক দিন ধরে পত্রপত্রিকা ও টেলিভিশনের টক শোতে চলছে এক বছরের মূল্যায়ন।
১১ আগস্ট ২০২৫