Ajker Patrika

জেলখানায়ও কষ্ট ভোলানোর পথ জানতেন

জাহীদ রেজা নূর, ঢাকা
জেলখানায়ও কষ্ট ভোলানোর পথ জানতেন

জেলখানা মোটেই সুখকর স্থান নয়। কিন্তু তার মানে শুধু অন্ধকার প্রকোষ্ঠে দিনাতিপাত করাই জেলজীবন নয়। জেলের জীবনও নানা গল্পময়। বঙ্গবন্ধুর জেলজীবনে যখন ঈদ এসেছে কিংবা যখন সবাই মিলে একটু ভালোমন্দ খাওয়া-দাওয়ার কথা ভেবেছেন, তখন এক দিনের জন্য হলেও জেল-জুলুমের কষ্ট তাঁরা ভুলে থাকতে পেরেছেন।

সে সময় রাজবন্দীদের খাওয়া ছিল জিনিসের বিনিময়ে, টাকাতে নয়। একজন বন্দী সে সময়ের হিসাবে এক পোয়া খাসি বা মুরগির মাংস পেতেন। রাজবন্দীরা ওই দামের হিসাবে অন্য কিছুও নিতে পারতেন। খাবার জমা করারও নিয়ম ছিল। সিভিল সার্জন চাইলে যেকোনো বন্দীর জন্য যেকোনো খাবারের নির্দেশ দিতে পারতেন। ফলে ঈদের দিন পোলাও-মাংস রান্না করেও সবাই মিলে খাওয়া চলত।

ঈদের কথা পরে। আগে বলে নিই ‘খিচুড়ি সংগ্রাম পরিষদ’-এর কথা। আওয়ামী লীগের নূরুল ইসলাম আর ছাত্রলীগের নূরে আলম সিদ্দিকীর নেতৃত্বে জেলখানার ভেতরেই খিচুড়ি সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলা হয়েছে। সেটা বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করেই। খবরের কাগজের কালি দিয়ে লিখে কাঁঠালগাছে পোস্টার টানানো হয়েছে ‘আমাদের দাবি মানতে হবে, খিচুড়ি দিতে হবে।’

হাতের লেখাটা যে নূরুল ইসলামের সেটা বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু এত মানুষের খাওয়ার মতো সরঞ্জাম জোগাড় করা সহজ কথা নয়। এরই মধ্য ২৯ এপ্রিল সকালে (১৯৬৭ সাল) বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব কয়েক সের চাল, ডাল, লবণ, ঘি, মরিচ, পেঁয়াজ ইত্যাদি পাঠিয়েছেন। ডিভিশন ‘ক’-এর কয়েদিরা ডিআইজি প্রিজনের অনুমতি নিয়ে এগুলো পাঠাতে পারেন। বঙ্গবন্ধু কিছু ডিম আর মুরগিও বাঁচিয়েছিলেন। তা দিয়েই খিচুড়ি সংগ্রাম পরিষদের দাবি মেনে খিচুড়ি রান্না হলো। বঙ্গবন্ধু দেখিয়ে দিয়েছিলেন কীভাবে রান্না করতে হবে। কিন্তু যে কয়েদিকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, তিনি খিচুড়িতে বেশি পানি দেওয়ায় তা চাল-ডালের ঘন্টে পরিণত হয়েছিল। পুরোনো ২০ সেলের ডিপিআর, ফালতু, পাহারা, মেটদেরও খাবার দেওয়া হলো। এভাবেই সংগ্রাম পরিষদের দাবি মানা হলো।

ঈদের সময়কার কথা। ঈদুল ফিতর। ১৯৬৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি। পশ্চিম পাকিস্তানে চাঁদ দেখা গেছে বলে জোর করে সেদিনই জেলখানায় ঈদ হলো। জেলের বাইরের মানুষ ঈদ পালন করেছিলেন ১৩ ফেব্রুয়ারি।

১০ নম্বর সেল থেকে খাবার এসেছিল, ২৬ নম্বর সেলের নিরাপত্তাবন্দীরাও খাবার পাঠিয়েছিলেন। বেলা ১১টার দিকে খাবার পাঠালেন বেগম মুজিব। বঙ্গবন্ধু সব খাবারই একটু একটু করে বিভিন্ন সেলে পাঠিয়ে দিলেন। আর ২০ নম্বর সেলের বন্দীদের সঙ্গে নিয়ে খাবেন বলে ঘোষণা করলেন। সেদিন আইনের তোয়াক্কা করলেন না। সবাই জেলখানার ঘরে বিছানা পেতে খাওয়ার এন্তেজাম করলেন। যে কয়েদিরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন, তাঁরাও খাবারের ভাগ পেলেন।শুধু ৪০ নম্বর সেলের ‘অপ্রকৃতিস্থ’ কয়েদিদের (বঙ্গবন্ধু বলেছেন ‘পাগল ভাই’) জন্য কিছু করতে পারলেন না।

এ কথাটা মনে ছিল বঙ্গবন্ধুর। সুযোগ বুঝে ১৫ ফেব্রুয়ারি নিজের হাতে মুরগি রান্না করে পাগল ভাইদের জন্য ৪০ নম্বর সেলে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। নিজের জমানো খাবার থেকেই তিনি এ খাবারের আয়োজন করেছিলেন। ওই সেলে যাওয়ার অনুমতি ছিল না তাঁর। তাই জমাদারকে অনুরোধ করলেন, ‘আপনি নিজে দাঁড়িয়ে ওদের মধ্যে খাবার ভাগ করে দেবেন।’ বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘ওরা যে আমার বহুদিনের সাথি, ওদের কি আমি ভুলতে পারি?’

সূত্র: শেখ মুজিবুর রহমান, কারাগারের রোজনামচা ও নূরে আলম সিদ্দিকী, সেকালের রাজনীতি ও ছাত্রলীগ

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত