Ajker Patrika

‘আমরা বেঁচে আছি’ বলার পর থেকেই মৃত্যুর নীরবতা

আপডেট : ১৭ নভেম্বর ২০২৩, ২১: ৩২
‘আমরা বেঁচে আছি’ বলার পর থেকেই মৃত্যুর নীরবতা

এক সপ্তাহ আগে গাজা শহর থেকে পাঠানো এক খুদে বার্তায় দিনা আলালামি জানতে পেরেছিলেন তাঁর পরিবারের সদস্যরা বেঁচে আছে। ৩৩ বছর বয়সী ও দুই সন্তানের মা দিনা পাঁচ বছর ধরে কাতারের রাজধানী দোহায় থাকেন। আজ শুক্রবার পর্যন্ত তিনি জানেন না তাঁর বোন, দুই ভগ্নিপতি, দুই ভাগনেসহ আরও তিন স্বজনের ভাগ্যে ঠিক কী ঘটেছে। তাঁরা কি আদৌ বেঁচে আছে, নাকি ইসরায়েলি বোমায় নিহত সাড়ে ১১ হাজার ফিলিস্তিনির ভাগ্য বরণ করেছে—এখনো জানা যায়নি।

আল জাজিরাকে দিনা জানিয়েছেন, ১০ নভেম্বর তাঁর বোন রুল্লা পরিবারসহ বাড়ি ছেড়ে গাজার দক্ষিণ অংশে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁরা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন—কারণ ইসরায়েলি ট্যাংকের বহর ধীরে ধীরে তাঁদের এলাকার দিকে এগিয়ে আসছিল এবং এলাকাটি প্রায় ঘিরে ফেলেছিল। অবস্থা এমন ছিল যে সেদিন বাড়ি ছেড়ে না পালালে রাতটুকু টিকে থাকা তাঁদের জন্য অসম্ভব হয়ে পড়বে।

সেই দিনটিতে কাতার থেকে রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট কর্মীদের কাছে বোনের পরিবারকে সাহায্যের জন্য অনুরোধ করেছিলেন দিনা। কিন্তু দুটি সংস্থাই জানিয়ে দেয়, এ ব্যাপারে তাদের কিছু করার নেই।

 ১০ নভেম্বরের সেই দিনটিতে হামলার লক্ষ্যবস্তুতে থাকা এলাকাগুলোয় চার ঘণ্টার জন্য একটি বিরতি দিয়েছিল ইসরায়েলি বাহিনী। এই সময়ের মধ্যে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর ছেড়ে গাজার দক্ষিণ দিকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল সেনারা। এই সুযোগে দুপুরের দিকে হাতে সাদা পতাকা নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল দিনার বোনের পরিবার। এই দলটিতে রুল্লা ছাড়াও দিনার আরেক বোন লিনাও ছিলেন। আর ছিল দুই বোনের দুই স্বামী। মূলত দুই ভাই বিয়ে করেছিলেন লিনার দুই বোনকে। সঙ্গে ছিল তাঁদের সন্তান ও পরিবারের অন্য সদস্যরা।

কাতারে থাকা দিনাকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে প্রতিমুহূর্তে এসব খবরাখবর জানাচ্ছিলেন সবার ছোট বোন রুল্লা। তাঁরা বাড়ি থেকে বেরোনোর পরই শব্দ ও চিৎকারের গোলযোগ ভেসে আসে মোবাইলে। কিছুক্ষণ পর রুল্লা দিনাকে জানান, একটি ইসরায়েলি ট্যাংক থেকে গোলার আঘাতে তাদের আরেক বোন লিনা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। তাঁর পোশাক ভেসে যাচ্ছিল রক্তে। 

এ অবস্থায় লিনাকে পাঁজাকোলা করে যতটুকু সম্ভব একটি ভবনের কাছাকাছি নিয়ে আসেন রুল্লা এবং প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি দেখতে পান—লিনার পাঁজরে গুলি লেগেছে। ইসরায়েলি ট্যাংক থেকে তখনো গুলি ধেয়ে আসছিল। উপায়ন্তর না দেখে আহত বোনকে গেটের কাছে রেখেই ভবনের ভেতরের দিকে ছুটে যান রুল্লা। তাঁর স্বামী বাশারের হাতে গুলি লেগেছিল। স্বামীর বোন ডালিয়াও মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। আর রুল্লার দাদি শাশুড়ি ইতিমধ্যে রাস্তার ওপর মরে পড়েছিলেন। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই নিজের অবস্থানের কথা জানিয়ে দিনাকে কিছু একটা করার অনুরোধ জানিয়েছিলেন রুল্লা।

দিনা জানান, আল-জায়তুন ফার্মেসির পেছনেই একটি ভবনে আশ্রয় নেওয়ার কথা জানিয়েছিল রুল্লা। পরে গাজায় কাজ করা কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে পরিবারসহ বোনকে উদ্ধারের অনুরোধ করেছিলেন তিনি। 

পরদিন শনিবার (১১ নভেম্বর) ভয়ংকর সব খবর পান দিনা। রুল্লা তাঁকে জানান, তাঁদের বোন লিনা মারা গেছে। তাঁর মরদেহটি তখনো ভবনটির গেটের সামনে পড়ে আছে। মারা গেছে স্বামীর বোন ডালিয়াও। আর ভবনটির ভেতরে তখনো আটকে ছিল রুল্লা ও তাঁর আহত স্বামী বাশার, লিনার স্বামী তারেক, চার বছর ও ৯ মাস বয়সী লিনার দুই ছেলেসহ আরও এক স্বজন। তাদের কাছে কোনো খাবার ও পানি ছিল না। বিদ্যুৎও ছিল না ভবনটিতে। রুল্লার মোবাইলের ব্যাটারি প্রায় শেষ হয়ে আসছিল। এ অবস্থান মধ্যেই দিনাকে পাঠানো তাঁর সর্বশেষ বার্তাটি ছিল, ‘আমরা বেঁচে আছি।’ 

এরপর আর কোনো সাড়া না পেয়ে কাতার থেকে মিসরের কায়রোতে ছুটে এসেছেন দিনা। সেখানেই আল জাজিরার সাংবাদিকদের কাছে তিনি বলেন, ‘আমার দুই বোন আমার চেয়ে ছয় ও সাত বছরের ছোট। তারাই আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। যদি তাদের সঙ্গে এই মুহূর্তে থাকতে পারতাম—আমরা একসঙ্গে মরতাম, না হয় বাঁচতাম।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত