Ajker Patrika

দখলে দূষণে বিপন্ন অতীত

অরূপ রায় ও রিফাত মেহেদী, সাভার (ঢাকা) থেকে
আপডেট : ১৪ নভেম্বর ২০২১, ১৬: ০৮
দখলে দূষণে বিপন্ন অতীত

ঢাকার সাভারের ধামসোনার ধলাই বিল। এ বিলের মাছ আর ধান আবাদের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন বিলপাড়ের মানুষ। এখন সেই বিলে আর আগের মতো মাছ নেই, হয় না ধানের আবাদ। কল-কারখানার তরল বর্জ্যে পানি দূষিত হওয়ায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

শুধু ধলাই বিল নয়, দখল আর দূষণে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে সাভারের পাকুরিয়া বিল ও বিল-বাগিল বিলসহ কর্ণপাড়া খাল।

বছরের পর বছর এই তিন বিল ও খাল দখল ও দূষণের শিকার হয়ে এলেও সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ইতিপূর্বে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে দেরিতে হলেও এসব জলাশয় রক্ষায় নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত বৃহস্পতিবার এ তিন বিল ও খালটি রক্ষার নির্দেশ দেন বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি মুহাম্মদ মাহবুব-উল ইসলামের বেঞ্চ।

ঢাকা রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা (ডিইপিজেড) ঘেঁষে বিস্তর এলাকাজুড়ে ধলাই বিল। বিলের পাশেই উনাইল, কন্ডা, কলতাসূতি, ডগরতলী, কাইচাবাড়ি, শুকুন্দি, মাইজাইল, গোপালবাড়ি, ধামসোনা, কাকরান ও নলাম গ্রাম। এসব গ্রামের অধিকাংশ মানুষের আয়ের একমাত্র উৎস ছিল এই বিল। দেশীয় নানা জাতের মাছ আর ধান আবাদের জন্য খ্যাতি ছিল ধলাই বিলের।

গত শুক্রবার বিলটি ঘুরে অনেকটা মরুভূমির মতো মনে হয়েছে। বিলের কোথাও ছোট-বড় হাজারো গর্ত আবার কোথাও বালু জমে চরের মতো হয়ে আছে। বিলের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে ইটভাটার একটি চিমনি। বিলের মধ্য দিয়ে প্রবাহমান বংশী নদের সরু শাখা। এই শাখা নদ দিয়ে বংশীর মূল স্রোতধারায় মিশে যাচ্ছে কারখানার তরল বর্জ্য। বর্জ্যমিশ্রিত পানি থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বৈশাখ মাসে বর্ষার পানিতে ধলাই বিল কানায় কানায় ভরে যেত। অগ্রহায়ণের শেষের দিকে পানি শুকিয়ে গেলেও বিলের ভেতর দিয়ে প্রবহমান ২০টি খালসহ বংশীর শাখায় সারা বছরই পানি থাকত। কারখানার তরল বর্জ্যের সঙ্গে বের হওয়া কঠিন বর্জ্যে কয়েক বছরেই বিলের ভেতর দিয়ে প্রবহমান খাল ভরে যায়। এদিকে বিলের ভেতরে গড়ে উঠেছে ইটভাটা। ধানের উৎপাদন কমে যাওয়ায় কৃষকেরা ভাটার মালিকের কাছে বিক্রি করে দেন জমির মাটি। এভাবেই ধলাই বিল তার ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলে।

নলাম গ্রামের কৃষক নূর মোহাম্মদ বলেন, তরল বর্জ্যের কারণে ধানের চারার গোড়া পচে যায়। ছড়ার অধিকাংশ ধানই হয় চিটা। এ কারণে বিঘাপ্রতি উৎপাদন কমে গেছে ১৫-১৭ মণ, যা বিক্রি করে খরচের টাকাও কৃষকেরা ঘরে তুলতে পারেন না। এ কারণে অনেক কৃষকই বিলে ধান চাষে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন।

নলাম মাঝিপাড়ায় অর্ধশতাধিক জেলে সম্প্রদায়ের বাস। মাঝিপাড়ার সুবল রাজবংশী একসময় ধলাই বিলে মাছ শিকার করতেন। ৩০ বছর আগে পেশা বদল করে বেসরকারি একটি স্কুলে পিয়নের চাকরি নিয়েছেন। মাছ না পাওয়া তাঁর মতো অনেকেই পেশা বদলেছেন।

ধামসোনার পাশের ইউনিয়ন পাথালিয়ার ঐতিহ্যবাহী বিলের নাম পাকুরিয়া। দখল আর দূষণে বিলটি এখন মৃতপ্রায়। পাশে কারখানা ও আবাসন প্রকল্পের কারণে বিলের আয়তন ক্রমে ছোট হয়ে এসেছে।

স্থানীয় কৃষক শের খান বলেন, একসময় খরস্রোতা ঝুক্কিজাঙ্গাল খাল এবং গকুলনগর ও সিঞ্জুরিয়া বিলের মাধ্যমে বংশী নদের দুই পাশে সংযুক্ত ছিল বিলটি। বর্ষায় ঝুক্কিজাঙ্গাল খাল দিয়েই পাকুরিয়া বিলে পানি ঢুকত। গত কয়েক বছরে ঝুক্কিজাঙ্গাল খালটি বেদখল হয়ে যাওয়ায় পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এখন বৃষ্টির পানিই একমাত্র ভরসা।

স্থানীয় পরিবহন ব্যবসায়ী সাহাজ উদ্দিন বলেন, গত কয়েক বছরে নয়ারহাট এলাকায় ঝুক্কিজাঙ্গাল খালের একাংশে গড়ে উঠেছে একাধিক বহুতল ভবন। অন্যপাশে কারখানার ভবন নির্মাণের জন্য মাটি ভরাট করে রাখা হয়েছে। বিলের পাশে গড়ে উঠেছে আবাসন প্রকল্প। ওই প্রকল্পে বিলের জমিসহ সরকারি জমি রয়েছে, যা উচ্ছেদের জন্য আন্দোলন করেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি।

সাভার পৌর এলাকার বিল-বাগিল মৌজায় বিস্তর এলাকাজুড়ে ছিল বিল-বাগিল বিল। এই বিলটিও দখল আর দূষণে অস্তিত্বহীন আজ। বিলের মাঝ দিয়ে করা হয়েছে সড়ক ও সেতু।

বিলের পাশের ঘাসমহলের বাসিন্দা মফিজ উদ্দিন বলেন, বিল-বাগিল কর্ণপাড়া খাল থেকে ডেইরি ফার্ম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ২০ বছর ধরে দখল আর দূষণে তা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। যতটুকু বাকি আছে তা কচুরিপানায় ভরা। বিলের ভেতর দিয়ে ১৫ থেকে ২১ ফুট প্রশস্ত খাল ছিল। দখলের কারণে খালটি হারিয়ে গেছে।

দখল আর দূষণের শিকার পৌর এলাকার কর্ণপাড়া খাল। খালের তীর ঘেঁষে একাধিক পাকা ও আধা পাকা ভবন গড়ে ওঠায় খালটি নালায় পরিণত হয়েছে। দেখে মনে হবে তরল বর্জ্য ও আবর্জনার ভাগাড়।

সাভার নদী ও পরিবেশ উন্নয়ন পরিষদের সহসভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, ‘সাভারের নদ-নদী, খাল-বিল দখল আর দূষণে অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। স্থানীয়ভাবে আন্দোলন করে জলাশয় ও নদী উদ্ধারে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। অবশেষে বেলার সহায়তায় আদালতের দ্বারস্থ হই। দীর্ঘদিন পর হলেও আদালত কার্যকর রায় দিয়েছেন। এবার দখল ও দূষণের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত