Ajker Patrika

অপদার্থ!

জাহীদ রেজা নূর
অপদার্থ!

কাণ্ডজ্ঞানহীনভাবে তৈরি হয়েছে এইচএসসির বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্নপত্র। সাম্প্রদায়িকভাবে স্পর্শকাতর জঘন্য এ প্রশ্নটির কথা ইতিমধ্যে নানা আলোচনায় অনেকেই জেনে গেছেন। নেপাল ও গোপাল দুই ভাইয়ের জমিবিরোধ নিয়ে কাহিনি ফেঁদে তার মধ্যে আবদুল নামের এক মুসলিমকে ঢুকিয়ে গরু কোরবানি করিয়ে নেপালকে ভারতে পাঠিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছে, মীরজাফর কোন দেশ থেকে এসেছে? নেপাল চরিত্রের সঙ্গে সিরাজউদ্দৌলা নাটকের মীরজাফরের তুলনা করতে বলা হয়েছে আরেকটি উদ্দীপকে।

হিন্দু হোক, মুসলমান হোক কিংবা অন্য যেকোনো ধর্মের মানুষই হোক না কেন, কোনো মানুষের ব্যাপারে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি যে একান্ত অরুচিকর, এ কথা প্রশ্নকর্তা এবং প্রশ্নের মডারেটরদের, কেউ যদি বুঝতে না পারেন, তাহলে বুঝতে হবে, আমাদের শিক্ষাঙ্গনে এ রকম দায়িত্বশীল জায়গায় তাঁদের মতো মানুষেরা দিব্যি আছেন, বেতন পাচ্ছেন, কিন্তু কেউ আগে থেকে জানতেও পারছে না, কতটা অপদার্থ তাঁরা। এ ধরনের অপদার্থের সংখ্যা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা প্রশাসনে কত শতাংশ, সেটা কি খুঁজে বের করা সম্ভব হবে? সংবিধানের প্রসঙ্গ না এনেও বলা যায়, শিশু-কিশোরদের মনে অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে এইচএসসি পরীক্ষার ঢাকা বোর্ডের শিক্ষার্থীদের সামনে উপস্থাপিত বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্নকর্তা এবং মডারেটররা চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছেন।

যে বিষয়গুলোতে এখন অবাক হই না, তার একটি হচ্ছে শিক্ষকদের যোগ্যতা। শিশু-কিশোরদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে প্রাথমিক শিক্ষার মূল্য অপরিসীম। সেটাই যেন ভুলতে বসেছি আমরা। স্কুল ও কলেজজীবনেই নেওয়া হয় জীবনের প্রথম পাঠ। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ভিত্তি খুঁজে পাওয়ার জন্য এ বয়সটাই সবচেয়ে দামি। এ সময়ই গড়ে ওঠে মানুষে-মানুষে সম্পর্ক, সংস্কৃতিবোধ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা, দেশপ্রেম এবং সর্বোপরি পৃথিবীর সব ভালোর সঙ্গে একাত্ম হওয়ার মানসিকতা। যাঁরা সেটা গড়ে তুলবেন, তাঁদের মধ্যে এই অপদার্থরা থাকলে ভালো কিছু কীভাবে আশা করা যাবে? এ ধরনের অপদার্থরা দেশকে লজ্জায় ফেলার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন।

প্রশ্নটি ঢাকা বোর্ডের, কিন্তু তা এসেছে অন্য বোর্ড থেকে। কোন বোর্ড বা কারা এই প্রশ্নপত্র তৈরির সঙ্গে জড়িত, তা খুঁজে বের করা হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ও আন্তশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব কমিটির সভাপতি তপন কুমার সরকার। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁদের পরিচয় জানা গেছে এবং ভয়াবহ ব্যাপার হলো, এই অপদার্থদের মধ্যে মুসলমান এবং হিন্দু দুই সম্প্রদায়ের মানুষই আছেন। মীরজাফরি নাটকের এই কুশীলবদের খুঁজে বের করা গেছে, এবার শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক—এ রকম কথা বলে দেওয়া খুব সহজ। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হবে কি? হয়তো কোনো শাস্তিও জুটে যাবে তাঁদের। তাতে কি কিছু বদলাবে? 
আসলে এই অপরাধের শাস্তি কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে কথা বলার আগে বলা দরকার, যে অঙ্গীকার নিয়ে এ দেশের জন্ম হয়েছে, তার সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক এই প্রশ্নপত্র। ঠান্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে কেউ যদি এ রকম প্রশ্ন করতে পারে এবং ঢাকা বোর্ডের শিক্ষার্থীরা এই প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য হয়, তাহলে বুঝতে হবে, আমরা আমাদের রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার থেকে কতটা দূরে সরে এসেছি, সে কথা বোঝার শক্তিও আমাদের নেই। এ ধরনের অপদার্থদের কারণেই সবার অগোচরে শিশু-কিশোরদের মনের ঘরটিও পরিণত হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিভূমিতে।

অস্বীকার করার উপায় নেই, সারা পৃথিবীর বিভিন্ন কোণে এখন উগ্রতার উত্থান ঘটছে। ধর্মীয়, জাতিগত, সম্প্রদায়গত বিভেদ বেড়ে চলেছে। ঠিক এ রকম একটি সময়ে আমাদের আগামী প্রজন্মকে ধৈর্যশীল, মানবিক, অসাম্প্রদায়িক, দেশপ্রেমী হওয়ার দিকে পরিচালিত করার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু সে শিক্ষা তারা পাবে কোথায়? শিক্ষালয় কিংবা পরীক্ষার হলকে যদি দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ সাম্প্রদায়িকতার বাহন বানানোর চেষ্টা করতে থাকে, তাহলে এই শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যৎ কী?

ঢাকা বোর্ডের বাংলা প্রথম পত্রের প্রশ্নপত্র তৈরিকারী এবং এর মডারেটদের পরিচয় জানা গেছে। কোনো অজুহাতেই তাঁদের দায়মুক্ত করা যাবে না। যে ধর্মের লোকই হোন না কেন, তাঁরা তাঁদের সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন। তাঁদের বড় শাস্তি দিতে হবে। সবাইকে বুঝতে হবে, শিক্ষকদের কিছু মৌলিক শিক্ষাদান এখন জরুরি হয়ে পড়েছে, নইলে এ ধরনের অপদার্থরাই একদিন শাসন করবে গোটা শিক্ষাঙ্গন।

জাহীদ রেজা নূর, উপসম্পাদক, আজকের পত্রিকা

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত