Ajker Patrika

আশা-ভরসার একমাত্র জায়গাটাই ছিলেন বঙ্গবন্ধু

মীর রাকিব হাসান
আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২২, ১০: ১২
আশা-ভরসার একমাত্র জায়গাটাই ছিলেন বঙ্গবন্ধু

১ মার্চ ১৯৭১। হোটেল পূর্বাণীতে চলছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি সদস্যদের বৈঠক। ছাত্র-জনতা মিছিলে শামিল হয়ে হোটেল পূর্বাণীর সামনে জড়ো হলে সভা শেষে বঙ্গবন্ধু বাইরে এসে কিছু নির্দেশনা দিলেন। তিনি আরও বললেন, ৭ মার্চ জনসভাতেই পরবর্তী পরিপূর্ণ কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। আমরা চাইছিলাম বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন।

৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু কী ঘোষণা দেবেন তা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম আমরা। দুপুরের পর রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) চলে এলাম। বঙ্গবন্ধুর আসতে একটু বিলম্ব হচ্ছিল। আমরা বেশ উত্তেজিত ছিলাম, পাকিস্তানিরা তাঁকে আটক করল কি না, তা নিয়েও চিন্তিত ছিলাম। কারণ তখন অবস্থাটাই এমন ছিল, যেকোনো সময় যেকোনো কিছু হয়ে যেতে পারে। আর আমাদের একমাত্র আশা-ভরসার জায়গাটাই ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ৭ মার্চ মাঠে উপস্থিত সবার বুকে যেন একটাই শব্দ অনুরণিত হচ্ছিল—স্বাধীনতা। ভাষণ শেষ হলে মানুষ যেন একটা দিকনির্দেশনা পায়। ভাষণের সময় আমি ঢাকা ক্লাবের দিকটায় ছিলাম। ওখান থেকেই বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনি। বঙ্গবন্ধু এমনভাবে ভাষণটা দিলেন যে পাকিস্তানিরা আক্রমণের সুযোগটা পেল না, আমাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে আক্রমণের সুযোগ দিলেন না বঙ্গবন্ধু। অন্যদিকে স্বাধীনতা ঘোষণা না করলে হয়তো জনগণ বিভ্রান্ত হতো। এই অবস্থায় এসে তিনি সমগ্র পৃথিবীর কাছে গ্রহণযোগ্য একটি ভাষণ দিলেন। ভাষণে কোনো একটা লাইনে পাকিস্তানি সেনাদের উনি বলেছেন, ‘তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো।’ আবার আমাদের উদ্দেশেও বলেছেন, ‘আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোকদের হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল।’ এটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত যে অত্যাচার করলে প্রতিরোধ করা যাবে। তিনি এর আগে নির্বাচন করে জয়যুক্ত হয়েছেন। নির্বাচন যখন হয়েছিল তখন জলোচ্ছ্বাস হয়েছিল। মাওলানা ভাসানী বলেছেন, ‘লাশের ওপর দিয়ে নির্বাচনে যাব না।’ বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আমি নির্বাচনে যাব।’ সেটা যে কতটা সঠিক ছিল, তা ৭ মার্চে বুঝতে পারলাম। কারণ একজন নির্বাচিত প্রতিনিধিই এভাবে বলতে পারেন। এভাবে সুকৌশলে বঙ্গবন্ধু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কাছে নিয়ে গেছেন। আমরাও বুঝে নিলাম স্বাধীনতার ভাষণ দিলেন। এই যে কৌশলী বক্তৃতা, সেটাই এখন পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বক্তৃতার স্বীকৃতি পেয়েছে।

আমরা তখন অসহযোগ আন্দোলন নিয়ে সক্রিয়। ৭ মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করি। আমি, ওয়াহিদুল হক, আতিকুল ইসলাম ও গোলাম মোস্তফা—আমরা চারজন গেলাম। তোফায়েল আহমেদ ভেতরে নিয়ে গেলেন। বঙ্গবন্ধু ড্রয়িং রুমে বসে ছিলেন। তিনি আমাদের বললেন, ‘তোদের কথামতো যদি টেলিভিশন-বেতার চলে তাহলে চলবে, নাহয় তোরা অসহযোগ আন্দোলন কর।’ এই কথা বলে উনি তৎকালীন তথ্যসচিব জহুরুল হক সাহেবকে ফোন দিলেন। আমাদের সামনেই বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমার ছেলেদের পাঠাচ্ছি, আপনি ওদের কথামতো যদি টেলিভিশন-বেতার চালাতে রাজি হন তাহলে বেতার-টিভি অসহযোগ আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত হবে না। নাহয় অসহযোগ আন্দোলনের অন্তর্ভুক্ত হবে।’

আমরা জহুরুল হক সাহেবের কাছে গেলাম। উনি আমাদের দুটি শর্ত দিলেন। পাকিস্তানের অখণ্ডতার ব্যাপারে কিছু বলতে পারবেন না। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপারে কিছু বলতে পারবেন না। উনি বললেন, শর্ত মানলে আপনাদের টেলিভিশনের দায়িত্ব দিতে পারি। ওনার টেলিফোন থেকেই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বললাম। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘শর্ত মেনে তোরা দখল কর।’

আমরা দুটি কমিটি করলাম। একটা আশরাফুজ্জামানকে প্রধান করে রেডিওর জন্য, আরেকটি মুস্তাফা মনোয়ারকে প্রধান করে টেলিভিশনের জন্য। এই কমিটি ৮ মার্চ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে টেলিভিশনে তাঁর ভাষণ প্রচার করল। ৭ মার্চের ভাষণটি সরাসরি সম্প্রচার হওয়ার কথা থাকলেও পাকিস্তানিরা তা হতে দেয়নি। ৭ মার্চের ভাষণটি সারা রাত প্রিন্ট করে ৮ মার্চ অডিও আকারে আমরা বাজারে ছেড়েছিলাম। ২৫ মার্চ পর্যন্ত আমরা অনুষ্ঠান করেছিলাম। এরপর তো মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়।

অনুলিখন: মীর রাকিব হাসান

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত