Ajker Patrika

উত্তরের শীতযাপন

রজত কান্তি রায়, ঢাকা
উত্তরের শীতযাপন

মেঘ পিওনের ব্যাগের ভেতর মন খারাপের দিস্তা,

মন খারাপ হলে কুয়াশা হয় ব্যাকুল হলে তিস্তা। […]

-ঋতুপর্ণ ঘোষ

সেখানে বন-পাহাড়ের দেশ নেই। আছে তিস্তা আর তার মরা সোঁতা, ব্রহ্মপুত্র, নাগর, ধরলা, দুধকুমার, কাঁকড়া, মহানন্দা, চিরি কিংবা শীর্ণ যমুনেশ্বরী বা খারুভাঁজ নদীর তীরে মিঠেকড়া রোদ। সেখানে বিস্তীর্ণ সমতলভূমির ওপর মেঘ পিয়নের ব্যাগ থেকে বিবর্ণ আখরে লেখা মন খারাপের দিস্তা দিস্তা চিঠি উড়ে আসে উত্তরের হিমেল বাতাসে। জল নেমে যাওয়া বিলে সেখানে এখন শাপলাগাছের গোড়ায় ঘাঁই মারে সোমত্ত শোল। কিঞ্চিৎ সোনালি হয়ে আসা শীতের দুপুরে বিষণ্ন বক ওড়ে মাছের আশায়। ধু ধু পাথারের দিগন্তে ধূসর বিকেলে তিস্তা ব্যাকুল হলে সেখানে কুয়াশা নামে, কখনো ঘন হয়ে, কখনো-বা রাজহাঁসের ডানার মতো সাদা হয়ে। পরিদের পাখায় ভর করে কেটে রাখা ধানের ওপর সেখানে গাঢ় সন্ধ্যা নামে ধীরে ধীরে, বিষণ্ন নয়। শীতের মৌতাত সেখানে জমে ওঠে সন্ধ্যার মুখে ধানের নাড়ার আগুনের চারপাশে গোল হয়ে।

সেটা আদতে কালো পিচের রাস্তা
এক বিরাট কালো অজগর পূর্ব-পশ্চিমে গা এলিয়ে শুয়ে আছে। আর সারি সারি পিঁপড়া তার ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে। ওপর থেকে দেখলে দৃশ্যটি সে রকমই মনে হবে। কিন্তু মাটিতে নামলেই দেখা যাবে, সেটা আদতে কালো পিচের রাস্তা। সোজা দক্ষিণ থেকে উত্তরে এসে মিশেছে রংপুরে। মেডিকেল মোড়ে একটু বাঁক ঘুরে চলে গেছে সোজা পশ্চিমে—দিনাজপুর কিংবা ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়ের দিকে। মাঝখানে পড়বে নীলফামারী জেলা। রংপুর থেকে সোজা উত্তরে লালমনিরহাট আর একটুখানি ডানে, অর্থাৎ উত্তর-পূর্ব দিকে কুড়িগ্রাম জেলা। এই হলো উত্তরবঙ্গের চৌহদ্দি। এই চৌহদ্দিতে এখন গল্পের হাট। সে গল্প শীতের।

শীতের সকালে রংপুর শহরগল্পটা পৌনে এক শ বছর আগের
অবশ্য যদি ‘আদি’ ও ‘অকৃত্রিম’ উত্তরবঙ্গের খোঁজ করতে চান, তাহলে যেতে হবে কাঁটাতারের সীমানা পেরিয়ে আসামের নিচের অংশ থেকে শুরু করে বিহারের পূর্ণিয়া পর্যন্ত। মাঝখানে পড়বে কোচবিহার। মূলত কোচবিহার রংপুরের অংশ কিংবা রংপুর কোচবিহারের অংশ। রাজনীতির মারপ্যাঁচে উত্তরবঙ্গ ভাঙতে ভাঙতে চারটি অংশে বিভক্ত। পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও লোয়ার আসাম মিলে তার দুটি অংশ ভারতে, একটি অংশ বাংলাদেশে। এই পূর্ণাঙ্গ উত্তরবঙ্গের গল্প অবশ্য শেষ হয়েছে আজ থেকে প্রায় ৭৫ বছর আগের এক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে। সে কথা থাক।

হিমেল দেশের শীতের গল্প
বাস, ট্রেন বা প্লেন; যানবাহন যা-ই হোক, দরজা খুললেই উত্তরের হিমেল বাতাসের ঝাপটা লাগবে এখন। শরীর একটু শিহরিত হবে। কিন্তু ঘোমটা ঢাকা সূর্যের মনোরম তাপ আশ্বস্ত করবে। এবার ভাবতে থাকুন আপনি কোথায় যাবেন। শীতে পুরো উত্তরবঙ্গের একই অবস্থা। ঢাকার বাইরের প্রতিটি শহরকে ‘মফস্বল’ বলার চল আছে আমাদের দেশে। সেই সূত্রে উত্তরবঙ্গের প্রতিটি শহর মফস্বল। তবে মাঝখান থেকে রংপুর হয়ে গেছে বিভাগীয় শহর। ফলে তার জেল্লা বাড়ছে দিন দিন।

এই শহুরে জেল্লা ছাড়িয়ে বেরিয়ে পরুন গ্রামের দিকে। যদি পরিচিত কেউ থাকে, তাহলে সুবিধা পাবেন। না থাকলেও সমস্যা নেই। শহর থেকে প্রতিটি উপজেলায় যাওয়ার বাস পাবেন। নিদেনপক্ষে লেগুনা বা টেম্পো পাবেন। চলে যান শহর ছাড়িয়ে যেদিকে মন চায়। তারপর ফিরে আসুন সন্ধ্যার মধ্যে। রাত হলেও সমস্যা নেই। রাস্তাঘাট এখন মোটামুটি নিরাপদ। প্রতিটি জেলা শহরে থাকার বন্দোবস্ত ভালো এবং সাশ্রয়ী। ফলে চিন্তার কোনো কারণ নেই।

কী দেখবেন
উত্তরবঙ্গে চোখ খুলে দেখার প্রধান বিষয় বিস্তীর্ণ উর্বর সমতলভূমি। সেখানে এখন আলু, গম, তামাকসহ বিভিন্ন ফসলের চাষ হচ্ছে। আর যদি ইতিহাস দেখতে চান তাহলে আছে দিনাজপুরের বিখ্যাত কান্তজিউ মন্দির, দিনাজপুর রাজবাড়ী, রামসাগর, রংপুরের তাজহাট জমিদারবাড়ি, বিখ্যাত ঐতিহাসিক চরিত্র পীরগাছার দেবীচৌধুরানীর হাট, পঞ্চগড়ের পাঁচ গড়, নীলফামারীর নীলকুঠি, বিন্যার দিঘি, পুরোনো লালমনিরহাট শহর কিংবা পুরোনো কুড়িগ্রাম শহর। রংপুরের চিড়িয়াখানা, রংপুর ও দিনাজপুর শহর, ভিন্নজগৎ, স্বপ্নপুরী, তিস্তা ব্যারাজ, শুকনো তিস্তা নদী, শিঙাড়া ফরেস্ট। এসবই দেখতে পাবেন। দেখতে পাবেন দেশের একমাত্র শতরঞ্জির উৎপাদন, রংপুর শহরের পাশের নিসবেতগঞ্জে। কিনতেও পারবেন ঢাকার চেয়ে কম দামে।

কী খাবেন
প্রথমেই জানিয়ে রাখি, উত্তরবঙ্গের মানুষ শীতকালেই মাত্র ধনেপাতা খায়। নরম রোদে পিঠ এলিয়ে দিয়ে সকালবেলা খাবেন পরোটা আর পাতলা আলুর ডাল, ধনেপাতা দেওয়া। খাবেন সরু সুগন্ধি কাটারিভোগ চালের সাদা ভাত, খাসির মাংসের গাঢ় খয়েরি ঝোল মেখে। ঐতিহ্যবাহী কোনো খাবার খেতে চাইলে রেস্তোরাঁয় পাবেন না। স্থানীয় বন্ধুদের বাড়িতে গিয়ে আবদার করতে হবে সিদল খাওয়ার। অথবা প্যালকা খাওয়ার। খাবেন কুড়িগ্রামের উলিপুরের বিখ্যাত মিষ্টি ক্ষীরমোহন, দিনাজপুর শহরের পুরোনো রেস্তোরাঁগুলোর খাবার— যেকোনো সময়, পাঁপর ভাজা, বীরগঞ্জের রসগোল্লা, রংপুরের শিঙাড়া হাউসের শিঙাড়া।

যাবেন যেভাবে
আকাশপথ, রেলপথ ও সড়কপথ—তিন পথেই উত্তরবঙ্গে যাওয়া যায়। ঢাকা থেকে প্রতিটি জেলা শহরে যাওয়ার বাস আছে। বিমানে গেলে প্রথমে যেতে হবে সৈয়দপুর। তারপর সেখান থেকে বিভিন্ন জেলা শহরে বাস কিংবা ভাড়ার গাড়িতে। গাড়ি ভাড়া করতে হলে দর-কষাকষি করে নেওয়াই ভালো। রেলে সরাসরি দিনাজপুর, রংপুর, পঞ্চগড়, লালমনিরহাট পর্যন্ত যাওয়া যায়। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলা শহর থেকেও উত্তরবঙ্গের যেকোনো শহরে যাওয়া যায় বাসে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত