Ajker Patrika

অফিস ঘুমায়, মানুষ জাগে

কাজল সরকার, হবিগঞ্জ
আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০২২, ১৫: ০০
অফিস ঘুমায়, মানুষ জাগে

রাত প্রায় ২টা। হবিগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের ফটকের সামনে বেশ কয়েকজন তরুণ। কেউ বসে গল্প করছেন। কেউবা হাঁটাহাঁটি করছেন। কেউবা সীমানা প্রাচী ঘেঁষে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। সরকারি এই অফিসে কাজ হয় দিনে। তরুণদের উপস্থিতি অফিসের সামনের অংশটিকে গভীর রাতেও জাগিয়ে রেখেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেল এ চিত্র কেবল এই রাতের নয়, প্রতি রাতেই সামনের অংশটিতে দেখা যায়। আর এই তরুণদের প্রত্যেকেই লাইনে জায়গা রেখেছেন। যাতে পরদিন পাসপোর্টের কাজ সারতে পারেন।

মঙ্গলবার মধ্য রাতে হবিগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সামনে গিয়ে কথা হয় কয়েকজনের সঙ্গে। এ সময় তাঁরা জানান, পাসপোর্ট কার্যালয়ে সেবা পেতে আগের রাতেই লাইনে দাঁড়াতে হয়। হবিগঞ্জ পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের সংখ্যা বেড়েছে। দিনে ৪০০ থেকে ৫০০ তরুণ আসেন। তবে যারা দিনে সেবা পান ১৫০ থেকে ১৬০ জন। বাকিদের ফিরতে হয় ব্যর্থ হয়ে। খালি হাতে না ফিরতেই কিছু তরুণের এই রাত জাগা।

বানিয়াচং থেকে ইবাদুর রহমান আঙুলের ছাপ দিতে রাত ৯টায় লাইনে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সকালে এসে লাইনে দাঁড়াই। সারা দিন পর বিকেলে বলে আর আঙুলের ছাপ নেওয়া হবে না। সেদিন চলে যাই। রোববার আবারও ভোরে আসি। এই দিনও বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করেও আঙুলের ছাপ দিতে পারিনি। তাই রাত ৯টায় এসে অফিসের ফটকের সামনে বসে আছি।’

মাধবপুর উপজেলার ইটাখোলা থেকে এসেছেন আব্দুল হামিদ। তিনি বলেন, ‘সন্ধ্যায় এসে লাইনে দাঁড়াইয়া রইছি। রাতে শীতের কষ্ট পাইতাছি। এরপরও কাজ হইব কি-না জানি না।’

নবীগঞ্জ উপজেলা আউশকান্দি এলাকার হাবিবুর রহমান বলেন, ‘একদিনে কাজ শেষ করতে পারছে না কেউ। আমাদের মতো অনেকে রাতে খোলা আকাশের নিচে থাকছেন।’

এদিকে অভিযোগ রয়েছে হবিগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে দালাল ছাড়া সেবা মিলে না।

মাধবপুর উপজেলার মনতলা এলাকার মো. মতিন খান বলেন, ‘রাত ৯টার সময় এসে সিরিয়ালে বসে আছি। আমার সামনে আরও ৩০ থেকে ৩৫ জন হইব আছে। কিন্তু কালকে দেখব আমার সিরিয়াল চলে গেছে ৭০ থেকে ৮০ নম্বরে। কারণ দালাল ধরলে কোনো সিরিয়াল লাগে না। যে যত বেশি টাকা দেব তার তত আগে সিরিয়াল হবে।’

সারা রাত পাসপোর্ট অফিসের সামনে খাবার বিক্রি করেন এক ব্যক্তি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘আমি মাসখানেক ধরে এখানে খাবার বিক্রি করছি। প্রতিদিনই সন্ধ্যা থেকে যুবকেরা পাসপোর্ট অফিসের সামনে এসে বসে থাকে। কেউ কম্বল গায়ে দিয়ে এখানেই ঘুমিয়ে পরেন। আবার কেউবা ঘোরাঘুরি করে রাত কাটান।’

ভোগান্তির বিষয়ে হবিগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক আইরিন পারভীন ডালিয়া বলেন, ‘প্রতিদিন ১৫০ বা ১৬০ জনের বেশি সেবা দেওয়া সম্ভব হয় না। অথচ প্রতিদিন সেবা নিতে আসেন ২০০-৩০০ জন। তবে এ সমস্যা সমাধানেও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। আশা করছি দ্রুত সবকিছু শৃঙ্খলার মধ্যে আসবে।’

দালাল না ধরলে সঠিক আবেদন ত্রুটিপূর্ণ দেখিয়ে বাতিল

বিভিন্ন অভিযোগের পর গত মঙ্গলবার হবিগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে অভিযান চালায় দুনীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই দিন দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত দুদকের হবিগঞ্জ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. এরশাদ মিয়ার নেতৃত্বে অভিযান চালায় এনফোর্সমেন্ট টিম। এ সময় দুদক কর্মকর্তারা পাসপোর্ট অফিসে কর্মরতদের মোবাইল ফোনের কললিস্ট যাচাই করে।

দুদক কর্মকর্তাদের তদন্তে বেরিয়ে আসে, দালাল না ধরে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করলে আবেদনে নানা ত্রুটি দেখিয়ে তা বাতিল করে দেয়। এ ছাড়া কর্মকর্তাদের ঘুষ না দিলে আবেদন নিতে দেরি করেন। তবে কোনো দালাল বা ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে আবেদন করলে ত্রুটিপূর্ণ আবেদনও গ্রহণ করা হয়। বিভিন্ন এজেন্সির সঙ্গে পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে।

দুদক হবিগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. এরশাদ মিয়া বলেন, ‘পাঁচ সদস্যের একটি দল সেখানে অভিযান চালায়। এ সময় বিভিন্ন কাগজপত্র খতিয়ে ‘দালাল ছাড়া সেবা না মিলার’ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। এ ব্যাপারে নথিপত্র, তথ্য-প্রমাণ এবং মোবাইলের কললিস্ট বিশ্লেষণ করে সুনির্দিষ্ট সুপারিশসহ কমিশন বরাবর প্রতিবেদন জমা দেওয়া হবে।’

হবিগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক আইরিন পারভীন ডালিয়া বলেন, ‘হবিগঞ্জ আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসকে দালাল মুক্ত করতে ও মানুষের ভোগান্তি কমাতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে আমি জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা বলেছি। শিগগিরই দালালদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হবে।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত