Ajker Patrika

পরিধি বাড়ুক প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার 

আলম শাইন
পরিধি বাড়ুক প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকার 

পরিবেশ কিংবা জলবায়ুর সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু শব্দ সাধারণ মানুষের বুঝতে সমস্যা হয়। এর অর্থ এই নয় যে শব্দগুলো অনেক কঠিন ভাষায় রচিত। আসলে শব্দগুলো সহজ-সরল বাংলা ভাষায়ই রচিত। তদুপরি বহুল প্রচলিত শব্দ হলেও এর অর্থ সর্বসাধারণের মাথায় ঢোকে না। আবার সামান্য একটু বুঝিয়ে দিলেই বিষয়টা মনে রাখতে পারেন অনেকেই।

তেমনি কিছু শব্দ আছে, যেমন জীববৈচিত্র্য, জলবায়ু পরিবর্তন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, ওজোনস্তর ও প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ইত্যাদি। এর আগে শব্দগুলো নিয়ে আলোচনা করা হলেও প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা নিয়ে আলোচনা করা হয়নি। তাই আজকের আলোচ্য বিষয় ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ নিয়ে।

তবে আলোচনার আগে আমাদের জেনে নিতে হবে সেই উপরিউক্ত শব্দগুলোর অর্থ। যেমন ‘মানুষের নানা কর্মকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত অথবা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা বোঝায়।’ সহজ বাংলায় পরিবেশ অথবা জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হলে ওই এলাকাকে ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ বলা হয়।

ইংরেজিতে বলা হয় ‘ইকোলজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া’, সংক্ষেপে ‘ইসিএ’। যাঁরা পরিবেশ নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের কাছে শব্দগুলো ব্যাপক পরিচিত। অন্যদের কাছেও যে অপরিচিত শব্দ, তা কিন্তু নয়। শুধু বোঝার ব্যাপারটাই কাজ করে; অন্য কিছু নয়।

আমাদের দেশে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা নিরূপণ করা হয়েছে ১৯৯৫ সালে, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে। সেই আইনে প্রথম দেশের আটটি এলাকাকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আরও চারটি এলাকা সংযোজন করা হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশই জলাভূমি। এলাকাগুলো যথাক্রমে—সুন্দরবন, কক্সবাজার, টেকনাফ উপদ্বীপ (পেনিনসুলা), সেন্ট মার্টিন দ্বীপ, সোনাদিয়া দ্বীপ, সিলেটের হাকালুকি হাওর, টাঙ্গুয়ার হাওর, নড়াইলের মারজাত বাঁওড়, ঢাকাবেষ্টিত বুড়িগঙ্গা নদী, তুরাগ নদ, বালু-শীতলক্ষ্যা নদ-নদী ও গুলশান-বারিধারা লেক।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫-এর সংশোধিত ধারা ৫-এর বিভিন্ন উপধারায় বিস্তারিত তথ্য দেওয়া আছে। ব্যাখ্যা দেওয়া আছে, কেন এই ১২টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেই ব্যাখ্যার যৎসামান্য তথ্য নিচে তুলে ধরার চেষ্টা করছি আমরা।

প্রথমে সুন্দরবনের কথায় আসা যাক। এই বন শুধু আমাদের জাতীয় সম্পদই নয়, এটি আমাদের জাতীয় বনের মর্যাদাও পেয়েছে। এ ধরনের শ্বাপদসংকুল বৃহৎ ম্যানগ্রোভ অরণ্য বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি নেই। যেমন দুর্গম, তেমনি জীববৈচিত্র্যে ঠাসা এ বন। এ বনটি বিভিন্ন কারণে ঝুঁকির সম্মুখীন বিধায় এর চারপাশের প্রান্ত থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার এলাকা প্রতিবেশ সংকটাপন্ন হিসেবে ঘোষণা করেছে সরকার। ফলে যে কেউ ইচ্ছে করলেই অবাধে মৎস্য আহরণ, গাছগাছালি কর্তন করতে পারে না।

তাতে করে মৎস্য সম্পদ ও বৃক্ষরাজি রক্ষার পাশাপাশি জীববৈচিত্র্যের সার্কেল সুরক্ষিত হচ্ছে। সিলেটের হাকালুকি ও টাঙ্গুয়ার হাওর, নড়াইলের মারজাত বাঁওড় মিঠাপানির জলাশয়। এতদঞ্চলের জীববৈচিত্র্য, জলজ উদ্ভিদ, পরিযায়ী পাখি স্থানীয় লোকদের অত্যাচারের কারণে অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার এই হাওর-বাঁওড়গুলোকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ফলে ওই সব অঞ্চলে কেউ মর্জি মোতাবেক সম্পদ বিনষ্ট করার সুযোগ পাচ্ছে না।

আলম শাইনকক্সবাজার-টেকনাফের উপদ্বীপ বন্য প্রাণীর প্রজননক্ষেত্র এবং সামুদ্রিক প্রাণীদের নিরাপদ চারণভূমি বিধায় এ দুটি অঞ্চলকেও সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। তাতে করে সামুদ্রিক প্রাণী ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা পাচ্ছে।

সেন্ট মার্টিন ও সোনাদিয়া দ্বীপের গুরুত্ব এবং জীববৈচিত্র্যের আধিক্যের কারণে এ দুটি দ্বীপকেও সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। এখানে দুর্লভ অলিভ রিডলি টার্টলের (জলপাইরঙা কাছিম) প্রজননস্থল। এ ছাড়া সোনাদিয়া দ্বীপে বিপন্ন প্রজাতির পাখি চামচঠুঁটো বাটানের আবাসস্থল। অপরদিকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে দুর্লভ জীববৈচিত্র্য ছাড়াও পরিবেশগত কারণে ঝুঁকির সম্মুখীন; বিশেষ করে এই দ্বীপ পর্যটক দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে চরমভাবে। যেমন পলিথিন, কোমল পানীয়র কৌটাসহ নানান আবর্জনা ফেলে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। অপরদিকে পর্যটকদের রাত্রিযাপন কিংবা আয়েশের জন্য বেশ কিছু হোটেল-মোটেল গড়ে উঠেছে। এতে করে মাটি খোঁড়াখুঁড়ির প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ফলে সেন্ট মার্টিন ভাঙনের কবলে পড়ে, বিষয়টি গোচরীভূত হতেই সরকার রাত্রিযাপনে নিষেধাজ্ঞাসহ দ্বীপটিকে সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।

অপরদিকে বুড়িগঙ্গা নদী, তুরাগ নদ, বালু-শীতলক্ষ্যা নদ-নদী ও গুলশান-বারিধারা লেক অসহনীয় মাত্রায় দূষণের কবলে পড়ে। কলকারখানার নির্গত অপরিশোধিত বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ, পলিথিন ও গৃহস্থালির আবর্জনায় জলাশয়ের তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে।পানি বিবর্ণ হয়ে এসেছে, দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। জলজ উদ্ভিদ, পোকামাকড় ও মাছ মারা যাচ্ছে; স্থান বদল করছে। এসব প্রতিবেশগত কারণে জলাশয়গুলো হুমকির সম্মুখীন হয়েছে, ফলে সরকার সংরক্ষিত হিসেবে চিহ্নিত করেছে এ এলাকাগুলোকে।

দেশে এ ধরনের আরও কিছু সংকটাপন্ন এলাকা রয়েছে। এর মধ্যে ‘চলনবিল’ অন্যতম। আমরা আশাবাদী, বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে সেটিও সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে ঘোষিত হবে একদিন। শুধু চলনবিলই নয়, দেশে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ জলাশয় কিংবা বন-বনানী রয়েছে, সেসব এরিয়াকে অতিসত্বর ‘প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে দ্রুত উদ্যোগ নিতে হবে। এখানে বলে নেওয়া আবশ্যক, সরকার বিভিন্ন সংকটাপন্ন এলাকা সংরক্ষিত হিসেবে ঘোষণা করলেও এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব সরকারের একার নয়; আমাদের ঘাড়েও বর্তায়, যা সবার মনে রাখতে হবে। কারণ, দেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখার দায়িত্ব সবারই। আমাদের বেঁচে থাকতে হলে জলবায়ুর পরিবর্তন যেমন ঠেকাতে হবে, তেমনি জীববৈচিত্র্যও রক্ষা করতে হবে। বলে নেওয়া ভালো, আমাদের বেঁচে থাকার সঙ্গে এ সার্কেলটি বিশেষভাবে যুক্ত।

সুতরাং আমরা জলবায়ু পরিবর্তন রোধ এবং জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করি উদ্দাম গতিতে। আমরা জানি, পরিবেশ নিয়ে কাজ করতে হলে একটি মাধ্যম প্রয়োজন। আর সেই উৎকৃষ্ট মাধ্যমটি হচ্ছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো। তাই আমরা ইচ্ছা করলে সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে সবুজ বাঁচিয়ে জলবায়ুর পরিবর্তন রোধ করতে পারি। পাশাপাশি পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকাগুলোর গুরুত্ব মানুষের কাছে তুলে ধরি। নিজের উদ্যোগে প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিয়ে দেশকে সবুজ সমাহারে ভরে তুলি। এ বিষয়ে কাজ করতে যুব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানাচ্ছি আমরা, ‘আসুন, ফেসবুকে সময় না কাটিয়ে দূষণমুক্ত বাংলাদেশ তথা সবুজ বিশ্ব গড়ে তুলি নিজ দায়িত্বে।’ তবেই তো এ সবুজ গ্রহটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়তে পারবে, সে সঙ্গে আমরাও বেঁচে থাকার যথাযথ উপাদান পেয়ে যাব।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও জলবায়ুবিষয়ক কলামিস্ট

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত