Ajker Patrika

১৯৫৫ সালের পর প্রথম নারীকে ফাঁসি দিতে যাচ্ছে ভারত

আপডেট : ২৫ এপ্রিল ২০২১, ১৭: ৩৮
১৯৫৫ সালের পর প্রথম নারীকে ফাঁসি দিতে যাচ্ছে ভারত

ঢাকা: ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের বাওয়ান খেরি গ্রামে রাত ২টার পরে সাহায্যের জন্য এক নারীর কান্নার শব্দে ঘুম ভাঙে প্রতিবেশীদের। নির্বিচারে হত্যার এক ভয়ানক দৃশ্য দেখতে তারা চোখ ঘসতে ঘসতে বিছানা ছেড়ে উঠে বসেন।

২০০৮ সালের ১৫ এপ্রিলের ঘটনা এটি। একটি দোতলা বাড়ি থেকে আসছিল কান্নার শব্দ। সবার আগে সেখানে যেকজন পৌঁছেন তাদের মধ্যে লতিফ উল্লাহ খান একজন। তিনি দেখেন, শবনম তার বাবা শওকত আলীর কাছেই মেঝেতে অচেতন অবস্থায় পড়ে আছেন। বাবার ঘাড় ছিল কাটা।

আদালতের নথিতে দেখা যায়, শবনমের দুই ভাই, তার মা, ভাবি এবং ১৪ বছরের চাচাত ভাইয়ের মৃতদেহ প্রায় শিরশ্ছেদ অবস্থায় রক্তাক্ত মেঝেতে পড়ে ছিল। শবনমের শিশু ভাতিজা পড়ে ছিল বাবা-মায়ের নিথর দেহের মাঝখানে। যেন সে ঘুমাচ্ছিল। পরে জানা যায় তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে।

এই খবর পরদিনই সব পত্রিকার শিরোনাম হয়। পত্রিকাগুলোতে লেখা হয়, শবনম ১০ মাসের এক শিশুসহ তার পরিবারের সাত সদস্যকে খুন করেছেন। তিনি তখন আট সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বাও ছিলেন। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ার পর শবনম ও তার প্রেমিক সালিমকে এ হত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয় এবং তাদের ফাঁসির দণ্ড দেওয়া হয়।

এখন যদি শবনমের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় তবে ১৯৫৫ সালের পর ভারতে ফাঁসি কার্যকর হওয়া প্রথম নারী হবেন তিনি।

তবে শবনমের আইনজীবীরা এই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর ঠেকানোর চেষ্টা করছেন। এক আইনজীবী শ্রেয়া রাস্তোগি বলেন, তার মক্কেল কখনও অপরাধ স্বীকার করেননি। তিনি বরং পিতৃতান্ত্রিক সমাজের শিকার। যে সমাজ বর্ণ–গোত্রকে সবার উপরে রাখে।

সেই রাতে নিহত লোকদের পাশাপাশি, এই জুটির অপরাধের আরেক শিকার তাদেরই ছেলে বিট্টু (আসল নাম নয়)। বিট্টুর জন্ম কারাগারে। এখন বয়স ১২ বছর। সে ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের কাছে তার মাকে ক্ষমা করে দেওয়ার আবেদন করেছে।

নেপথ্য কারণ

শবনম ও সালিম একে অপরকে ভালোবাসতেন। তারা ছিলেন একই গ্রামের বাসিন্দা। তবে কোনো পক্ষের পরিবারই এ সম্পর্ক মেনে নেয়নি।

খুনের ঘটনাটি যখন ঘটে তখন শবনমের বয়স ২২ বছর। সাইফি সম্প্রদায়ের একজন সুশিক্ষিত পেশায় শিক্ষক ছিলেন তিনি। আর সালিম (২৪) ছিলেন বেকার পাঠান যুবক।

যদিও ভারতে বর্ণপ্রথা মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিষয়, কিন্তু মুসলিম পরিবারগুলোর মধ্যে তাদের পারিবারিক ঐতিহ্যগত পেশা বা আরব বিশ্বের কোন অংশ থেকে তাদের পূর্বপুরুষ এসেছিলেন এটির ওপর ভিত্তি করে সামাজিক মর্যাদার একটি শ্রেণিবিন্যাস রয়েছে।

দেখা যায়, তথাকথিত অভিজাত বংশের পরিবারগুলো সন্তানদের সম্প্রদায়ের বাইরে বিয়ে দেয় না। এটি করতে ব্যর্থ হলে সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এমনকি সম্মানরক্ষার জন্য হত্যার (অনার কিলিং) মতো ঘটনাও ঘটতে পারে।

ওই হত্যাকাণ্ডটির আগে শবনমের ভাবি আঞ্জুমের বাবা লাল মোহাম্মদ তাদের সম্পর্কের বিষয়টি পুলিশকে জানিয়েছিলেন।

২০০৮ সালে আদালতে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে লাল মোহাম্মদ তার মেয়েকে স্মরণ করে বলেন, শবনম ভুল পথে চলেছে। সে সালিমকে বিয়ে করতে চায়। এ নিয়ে বাড়ির পরিবেশ খুব উত্তেজনাপূর্ণ ছিল।

শবনম যে স্কুলে পড়াতেন সেটির এক সহকর্মী শিক্ষক নিছা তিয়াগি সাক্ষ্যদানকালে বলেন, শবনম তাকে বলেছিলেন যে তিনি সালিমকে বিয়ে করতে চান। কিন্তু পরিবার মানছে না। শবনমের চাচাতো ভাই সুখখান আলী আদালতকে বলেছিলেন, সালিম প্রায়ই দেখা করতে শবনমদের বাড়িতে আসতেন। তার বাবা এটি পছন্দ করতেন না। এ নিয়ে শবনমকে মারধরও করতেন।

কিন্তু এরই মধ্যে একটা বিষয় ঘটে গিয়েছিল যা শবনমের পরিবার জানতো না। শবনমের গর্ভে এসেছিল সালিমের সন্তান। পরে আদালত বিষয়টি জানতে পারে।

জেলা আদালতের বিচারক এসএএ হুসেনি রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, স্থানীয়রা তাদের অনাগত অবৈধ সন্তানের বিষয়টি গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত ছিল না। তবে বিচারক বলেন, সাতজনকে হত্যা না করে বাওয়ান খেড়ির ‘রক্ষণশীল সমাজ’ থেকে পালিয়ে যাওয়ার অন্য বিকল্প কিন্তু এই জুটির হাতে ছিল।

হত্যাকাণ্ডের সময় শবনম তার আট সপ্তাহের অন্তঃসত্ত্বা থাকার বিষয়টি জানতেন কিনা তা পরিষ্কার নয়।

কৌঁসুলিরা বলেছেন, শবনম এটি জানতেন। আর এটি তাকে কিছুটা হলেও হত্যাকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ করেছিল। তারা যুক্তি দেন যে শবনম তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করতে চেয়েছিলের যাতে সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী হতে পারেন। আর এরপর তিনি সালিম এবং তাদের সন্তানকে নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে বাঁচতে পারবেন।

তবে শবনমের আইনজীবী রাস্তোগি বলছেন, এই তত্ত্বটি প্রমাণ করার জন্য কৌঁসুলিরা খুব কমই প্রমাণ হাজির করেত পেরেছেন। বিবাদী পক্ষের আইনজীবীরা বলছেন, গ্রেপ্তার হওয়ার পরে একটি রুটিন মেডিকেল চেকআপ চলাকালীনই কেবল শবনম জানতে পারেন তিনি গর্ভবতী।

যেভাবে ঘটলো হত্যাকাণ্ড

কাজটা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। আদালতের নথি অনুযায়ী, ১৪ এপ্রিল, ২০০৮-এ শবনম একজন ফল বিক্রেতার সহায়তায় ঘুমের ওষুধ কিনে আনান। এরপর সালিমের সাথে পরামর্শ করে সান্ধ্যকালীন চায়ে সেই ওষুধ মিশিয়ে পরিবারের সবাইকে পান করতে দেন। সবাই যখন গভীর ঘুমে, শবনম তখন সালিমকে ফোন করেন। সালিম একটি কুড়াল নিয়ে আসেন।

পরদিন জেলা পুলিশপ্রধানের সঙ্গে যোগাযোগ করেন চা বিক্রেতা বিলাল আহমদ। বিলালের কাছে সালিম বলেন, শবনম একে একে সবার মাথা ধরে ছিল আর আমি তাদের গলা কেটেছি। পরে সালিম আদালতে তাদের প্রেমের দোহাই দিয়ে এ হত্যাকাণ্ডের কথা স্বীকার করেন। যদিও শবনম আদালতে দাবি করেন, বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল। তারাই পরিবারের সদস্যদের হত্যা করেছে। কিন্তু তার দাবির সপক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

শবনম ও সালিমের ছেলে বিট্টু ওই হত্যাকাণ্ডের আট মাস পরে- ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে কারাগারে জন্মগ্রহণ করে। বিট্টুর পালক পিতা মার্কিন সংবাদ মাধ্যম সিএনএনকে তাঁর আসল নাম ব্যবহার না করতে অনুরোধ করেছেন। কারণ এতে শিশুটি সামাজিকভাবে হেনস্থার শিকার হতে পারে।

কারাগারে শবনম ছেলেকে ভালোভাবেই বড় করছিলেন। সেখানে অন্য নারীবন্দিদের শিশুরাও ছিল। তিনি তাদের পড়াতেন।

বিট্টুর বয়স যখন ছয় বছর তখন শবনমের কলেজবন্ধু উসমান সাইফি তাকে দত্তক নেন। তিনি একজন সাংবাদিকও। শবনমের ঘটনাটি নিয়ে একটি বই লেখার উদ্দেশ্য থেকেই কারাগারে যোগাযোগ করেন সাইফি। ২০১৫ সাল থেকে তিনি বিট্টুকে নিজের সন্তানের মতো লালন–পালন করছেন। শুধু বিট্টুর ভবিষ্যতের কথা ভেবেই সাইফি ও তার স্ত্রী শবনমের মৃত্যুদণ্ড রদ করার লড়াইয়ে নেমেছেন।

bittu

মৃত্যুদণ্ডের আসামি যখন নারী

আইনজীবী রাস্তোগি বিশ্বাস করেন, শবনমকে অন্যায়ভাবে অসুর বানানো হয়েছে। তার মৃত্যুদণ্ড রদ করা উচিত। বিশ্বব্যাপী মৃত্যুদণ্ড সম্পর্কিত কর্নেল ল স্কুলের গবেষণা রাস্তোগির দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন করে। দেখা যায়, যৌন আচরণের ক্ষেত্রে ‘নীতি লঙ্ঘনকারী’ নারীদের মৃত্যুদণ্ড পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ২০১৮ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, লঘু অপরাধে গুরু দণ্ড দেওয়া হয় নারীদের। মৃত্যুদণ্ড পাওয়া নারীকে ‘নারী ভয়ঙ্করী’, ‘শিশু হত্যাকারী’ বা ‘ডাইনি’ বলে অভিহিত করা হয়।

২০১৫ সালের মে মাসে শবনমের মৃত্যুর পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। তবে পরে আইনি জটিলতায় সেটি বাতিল হয়ে যায়। গত ফেব্রুয়ারিতে শবনম ও সালিমের পক্ষে আইনজীবী রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি হিসেবে উত্তরপ্রদেশ রাজ্যের গভর্নর এবং রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেন। শবনমের ১২ বছরের ছেলেও কালো স্লেটে মায়ের জন্য প্রাণভিক্ষা চেয়ে আদালতের সামনে দাঁড়িয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে এখনো সাড়া মেলেনি। ফলে শবনমের জন্য শুধুই মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত