Ajker Patrika

কম টিকা পাওয়ার খেসারত দিচ্ছে রাজশাহী

রিমন রহমান
আপডেট : ২৫ জুন ২০২১, ১২: ৫১
কম টিকা পাওয়ার খেসারত দিচ্ছে রাজশাহী

রাজশাহী: করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময়ই দেশে ভারত থেকে সেরাম ইনস্টিটিউটের উৎপাদিত অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা আসে। ওই টিকা থেকে সবচেয়ে কম পেয়েছে রাজশাহী অঞ্চল। এখন করোনার ভারতীয় ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের দ্বিতীয় ঢেউয়ে এ অঞ্চলকে খেসারত দিতে হচ্ছে। 

তবে যাঁরা টিকা নিয়েছেন, তাঁরা ভালো আছেন। কেউ কেউ দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার পরও সংক্রমিত হলেও খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েননি। বাড়িতে আইসোলেশনেই তাঁরা করোনামুক্ত হচ্ছেন। দ্বিতীয় ডোজ টিকা নেওয়ার পর রাজশাহী জেলায় শুধু একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।

রাজশাহীর সিভিল সার্জনের কার্যালয়ের হিসাবে, রাজশাহী জেলা সেরামের ১ লাখ ৮০ হাজার ডোজ টিকা পেয়েছিল। এরপর ১ লাখ ৩৩ হাজার ৭৭৪ জন টিকার প্রথম ডোজ নেন। নির্দিষ্ট সময় পর ৮১ হাজার ৬৪০ জন দ্বিতীয় ডোজও গ্রহণ করেন। কিন্তু মজুত শেষ হয়ে যাওয়ায় ৫২ হাজার ১৩৪ জন টিকার দ্বিতীয় ডোজ পাননি। গত ১৯ মে প্রথম দফার গণটিকা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এখন কিছু টিকা এলেও তা শুধু মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরাই পাচ্ছেন।

স্বাস্থ্য বিভাগের হিসাবে, সবচেয়ে কম টিকা পেয়েছেন রাজশাহী অঞ্চলের মানুষ। রাজশাহী জেলায় ২ দশমিক ৭৩, চাঁপাইনবাবগঞ্জে শূন্য দশমিক ৯৯, নওগাঁয় ২ ও নাটোরে শূন্য দশমিক ৮৮ শতাংশ মানুষ টিকা পেয়েছেন। বিভাগের অন্য চার জেলায়ও টিকা প্রয়োগের হার ১ শতাংশের কম। সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ টিকা পেয়েছেন ঢাকার মানুষ।

সীমান্ত জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জ হয়ে করোনার ভারতীয় ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট ঢুকে পড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে গোটা বিভাগে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. চিন্ময় কান্তি দাস মনে করেন, প্রথম দফায় গণটিকা কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারলে রাজশাহী অঞ্চলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এতটা বিধ্বংসী হতো না। তিনি বলেন, ‘প্রথম দফায় যাঁরা টিকা নিয়েছেন, তাঁরা অনেক ভালো আছেন। সংক্রমণ নেই বললেই চলে। হাতে গোনা কিছু মানুষ দ্বিতীয় ডোজ নিয়েও আক্রান্ত হয়েছেন।’

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে করোনা ইউনিটে দায়িত্ব পালন করেন ২৫২ জন চিকিৎসক। এ ছাড়া ৫৮০ জন নার্স এবং অন্যান্য ১৫২ জন চিকিৎসাকর্মী দায়িত্ব পালন করেন করোনা ইউনিটে। এ পর্যন্ত ১২৩ জন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে ১২০ জনই আক্রান্ত হয়েছেন করোনার প্রথম ঢেউয়ে। হাসপাতালের কিছু নারী চিকিৎসক ছাড়া সবাই টিকা নিয়েছেন। তারপর মাত্র তিনজন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন।

এদিকে করোনার প্রথম ঢেউয়ে রামেক হাসপাতালের ২৬৭ জন নার্স আক্রান্ত হয়েছিলেন। দ্বিতীয় ঢেউয়ে এ পর্যন্ত ৫৭ জন আক্রান্ত হয়েছেন। গর্ভবতী থাকা কিংবা অন্যান্য কারণে যাঁরা টিকা নিতে পারেননি, তাঁরাই এবার আক্রান্ত হয়েছেন। আর দ্বিতীয় ডোজ টিকা নেওয়ার পর হাসপাতালের মাত্র ছয়জন চিকিৎসাকর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। প্রথম ঢেউয়ে এ সংখ্যা ছিল ১০১ জন।

রামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, ‘অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা প্রত্যাশার চেয়েও বেশি কাজ করেছে। টিকা নেওয়ার পর চিকিৎসক-নার্সরা অনেকটাই ঝুঁকিমুক্ত। সেটা করোনার দুই ঢেউ তুলনা করলেই বোঝা যায়। টিকার কার্যকারিতা শতভাগের কাছাকাছি। এই টিকা চিকিৎসক, নার্সদের মনোবলও শক্ত রেখেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘টিকা নেওয়ার পরও যাঁরা আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের উপসর্গ কম। কয়েক দিন পরই তাঁরা করোনামুক্ত হচ্ছেন। অথচ এই টিকা নিয়ে মানুষের মনে কত ভয় ছিল। অনেকে তো ইচ্ছাকৃতভাবেই টিকা নেননি। তাঁরা এখন টিকা খুঁজছেন। না পেয়ে পস্তাচ্ছেন।’

টিকা নিয়ে ভীতি দূর করতে রাজশাহীতে প্রথমে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নিয়েছিলেন বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও সদর আসনের সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা। দ্বিতীয় ডোজও নিয়েছিলেন সবার আগে। কিন্তু পরে তিনি করোনা পজিটিভ হন। দুই ডোজ টিকা নিয়ে রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকারও আক্রান্ত হন। ফজলে হোসেন বাদশা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর শারীরিক তেমন জটিলতা ছিল না। আর ডাবলু সরকার বাসায় আইসোলেশনে থেকেই করোনামুক্ত হয়েছেন। টিকা নেওয়ার কারণে বড় কোনো সমস্যা হয়নি বলে তাঁরা মনে করেন।

দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পর রাজশাহীতে মাত্র একজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। তাঁর নাম গোলাম মোস্তফা। তিনি রাজশাহীর গোদাগাড়ীর বাসিন্দা ছিলেন। গোলাম মোস্তফার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। তাঁর স্ত্রী মমতাজ বেগম জানান, গোলাম মোস্তফা করোনায় আক্রান্ত হলে রামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এরপর হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রেও (আইসিইউ) রাখা হয়েছিল ৯ দিন। শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হলে তাঁকে সাধারণ ওয়ার্ডে দেওয়া হয়েছিল। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গোলাম মোস্তফা মারা গেছেন। তবে রাজশাহীর সিভিল সার্জনের কার্যালয় গোলাম মোস্তফার বিষয়টি ২৫ জুন পর্যন্ত জানে না।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা কতটা কার্যকর তা নিয়ে দেশে এ পর্যন্ত কোনো গবেষণা হয়নি। কোনো ফলাফলও প্রকাশ হয়নি। তবে এ ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করছে আইইডিসিআর। মাঠপর্যায়ে আইইডিসিআরের একজন কর্মকর্তা রাজশাহীতেও তথ্য সংগ্রহ করছেন। জেলার সিভিল সার্জনের কার্যালয়ও তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে। কারোরই তথ্য সংগ্রহ শেষ হয়নি। তবে এ পর্যন্ত যে তথ্য মিলেছে তাতে টিকার কার্যকারিতা খুব ভালো বলছেন তাঁরা। 

নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে আইইডিসিআরের তথ্য সংগ্রহকারী ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘টিকার রেজাল্ট খুব ভালো। দ্বিতীয় ডোজ টিকা নেওয়ার পর রাজশাহীতে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা এক শর মতো। গোটা বিভাগে এ পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা আড়াই শর কাছাকাছি পাওয়া গেছে। তবে তথ্য সংগ্রহ এখনো শেষ হয়নি।’ তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন যে হারে আক্রান্ত হচ্ছে, সেই তুলনায় টিকার প্রথম ডোজ নিয়ে আক্রান্তের হারও খুবই কম।’

রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. কাইয়ুম তালুকদার বলেন, ‘টিকার কার্যকারিতা নিয়ে আমাদের দেশে গবেষণার কোনো ফল প্রকাশ হয়নি। তবে আইইডিসিআর চেষ্টা করছে, আমরাও তথ্য পাঠাচ্ছি। যখনই খবর পাচ্ছি টিকা নেওয়ার পরও একজন আক্রান্ত হয়েছেন, সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করে পাঠাচ্ছি। এ পর্যন্ত মৃত্যুর কোনো খবর পাইনি। তাই বলা যায়, টিকা শতভাগ কার্যকর।’ 

চাঁপাইনবাবগঞ্জে করোনার ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হওয়ার পর সেই জেলায় সংক্রমণ দ্রুত বাড়ছিল। জেলায় বিশেষ লকডাউন দেওয়ার পর সংক্রমণ কমে এসেছে। কিন্তু রাজশাহীতে ১১ জুন থেকে লকডাউন দেওয়া হলেও সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা কমছেই না। এ জেলায় প্রতিদিনই তিন শর বেশি নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছেন। বিভাগের অন্য জেলাগুলোয়ও বাড়ছে সংক্রমণ। বিভাগের আট জেলা মিলে প্রতিদিন শনাক্তের সংখ্যা প্রায় এক হাজার জন।

সিভিল সার্জন বলেন, ‘রাজশাহীতে যদি বেশি করে গণটিকা কার্যক্রম চালানো যেত, তাহলে এখন ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট এতটা খারাপভাবে আঘাত করতে পারত না। কিন্তু এখন সংক্রমণের উচ্চপর্যায়ে এসে যদি টিকা পেয়েও যাই, তাও প্রয়োগ ঠিক হবে না। কারণ, আক্রান্ত ব্যক্তি টিকা গ্রহণ করলে শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে। আমাদের এখন একটু অপেক্ষা করাই ভালো।’

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত