Ajker Patrika

‘প্রিয় বোনটি আর কোনো দিন আমাকে দেখতে আসবে না’

নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকা
‘প্রিয় বোনটি আর কোনো দিন আমাকে দেখতে আসবে না’

আমার বাবা দেশের স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিয়ে গেছেন। সেই স্বাধীন দেশের সড়ক আমার বোনের রক্তে ভিজে গেল। এই বোনটা আমাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসত। প্রতি সপ্তাহে আমাদের দেখতে চলে আসত। কারণ সপ্তাহের অন্য সময়ে অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকায় দেখা হতো না। আমার প্রিয় বোনটা আর কোনো দিন আমাকে দেখতে আসবে না। ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সামনে বোনের শোকে আহাজারি করে কথাগুলো বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষকের গাড়ি চাপায় নিহত রুবিনা আক্তার রুবির ভাই জাকির হোসেন মিলন।

এই সময়ে নিহত রুবিনার ভাইবোন ও স্বজনদের আহাজারিতে ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সামনে এক হৃদয় বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।

স্বজনরা বলছেন, এটা কোনোভাবেই সড়ক দুর্ঘটনা নয়। গাড়ি চালক ইচ্ছে করে রুবিনাকে এত দূরে টেনে নিয়ে গেছেন। এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হোক। রুবিনার মতো যেন আর কেউ এমন হত্যাকাণ্ডের শিকার না হন।

বোনকে হারিয়ে ভাই জাকির হোসেন মিলনের আহাজারিরুবিনার ভাই মিলন বলেন, ‘প্রতি শুক্রবার আমরা পাঁচ ভাই ও দুই বোন একসঙ্গে খাবার খেতাম। সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতে ব্যস্ত থাকি। তাই প্রতি শুক্রবার এক হতাম। বোনের ছেলের জন্য প্রতি সপ্তাহে বিভিন্ন জিনিসপত্র কিনে দেই। গতকাল শুক্রবার বাসায় আসার পথেই এই ঘটনা ঘটল। আমার বোনকে বহনকারী মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেওয়ার পরও যদি গাড়িটা থামতো তাহলে আমার বোনটা বেঁচে যেত। কিন্তু কী কারণে চালক এত দূর টেনে নিয়ে গেল বুঝতে পারছি না।’ 

রুবিনার ভাই মিলন আরও বলেন, ‘আমার বাবা স্বাধীনতা যুদ্ধে বিহারিদের হাতে শহীদ হয়েছেন। আমি শুনেছি উনিও (ঢাবি শিক্ষক) নাকি বিহারি। আমার বোনও তার হাতে মারা গেল। বেপরোয়া গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা উচিত। আমার বোন মারা গেছে। হাজার হাজার মানুষের ভাই-বোন মারা যাচ্ছে। আমারও এখন নিরাপদ সড়কের আন্দোলনে যোগ দিতে ইচ্ছে করছে।’

বেপরোয়া গতির গাড়ি কেড়ে নেয় রুবিনা আক্তার রুবির প্রাণজানা গেছে, নিহত রুবিনার বাবা শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা বিডিআরের লে. নায়েক রফিক উল্লাহ। তিনি ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম দিকে পিলখানায় নিহত ৮ বিজিবি সদস্যের একজন। ছোটবেলায় বাবাকে হারানো রুবিনার পাঁচ ভাই ও বোনকে মা একাই মানুষ করেছেন। তাদের পরিবার রাজধানীর হাজারীবাগ থানার ৩ নং ভাগলপুর লেনে থাকত। নিহত রুবিনাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ের অধিভুক্ত হোম ইকোনমিকসের শিক্ষার্থী ছিলেন।

 ২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর স্বামী মাহবুব আলম ডলারকে হারান রুবিনা আক্তার রুবি। তাদের ২৩ বছরের সংসার ছিল। একমাত্র ছেলে রোহানকে (১৩) নিয়ে স্বামীর পৈতৃক বাড়িতে ননদের সঙ্গে বসবাস করে আসছিলেন। বাড়ির ফ্ল্যাট ভাড়ার টাকায় চলতো রুবিনার সংসার।

আজ শনিবার রাজধানীর তেজগাঁও থানার তেজকুনি পাড়ার হোন্ডা গলিতে রুবিনাদের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, নীরব নিস্তব্ধ। যেন শোকের ছায়া ফুটে উঠেছে। স্বজনদের আহাজারি না থাকলেও নীরবতা বাড়ি জুড়ে।

পাঁচ তলা ভবনের দোতলায় গিয়ে দেখা গেছে, শুক্রবার সকালে রুবিনার করে রাখা বাজার পড়ে আছে। রুবিনা আচার তৈরি করার জন্য জলপাই ও বিভিন্ন সবজি কিনে রেখেছেন। বাসার সদস্যরা রুবিনার হঠাৎ মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ। বাবার বাসা থেকে ফিরে আসার কথা বলে বের হওয়া মানুষটি আর বেঁচে নেই। এটাই মানতে পারছেন না তারা। স্বজন ও বাড়ির ভাড়াটিয়া সকলের কাছে প্রিয় মানুষ ছিলেন রুবিনা। হাসি খুশি ও আড্ডা প্রিয় রুবিনা সবাইকে খাওয়াতে পছন্দ করতেন। তার হাতের তৈরি আচারসহ বিভিন্ন খাবার আনন্দ নিয়ে খাওয়াতেন স্বজন, প্রতিবেশী এমনকি ছেলে স্কুলের শিক্ষক ও অভিভাবকদের।

রুবিনার ননদ আবিদা সুলতানা ডলি বলেন, ‘সে (রুবিনা) খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। সে আমার সঙ্গেই থাকত। আমরা যৌথ পরিবার হিসেবে ছিলাম। প্রতি সপ্তাহে বাবার বাড়িতে যেতেন। তবে সেখানে বেশি সময় থাকতেন না। আর কোথাও একা যেতেন না সঙ্গে কেউ না কেউ থাকত। আর বাবার বাসায় যাওয়া সময় আমার স্বামীকে (নুরুল আমিন) নিয়ে যেত। অত্যন্ত সহজ সরল মানুষ ছিলেন।’

রুবিনার বাসার নিচতলার ভাড়াটিয়া ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘এই বাসায় দীর্ঘদিন ধরে ভাড়া থাকি। সে (রুবিনা) আমাদের সঙ্গে আপন মানুষের মতো ব্যবহার করতেন। বাসায় কোনো কিছু তৈরি করলে নিয়ে আসতেন। গতকাল যাওয়ার সময়েও দেখা হয়েছে। কিন্তু এই দেখা যে শেষ দেখা সেটি বুঝতে পারিনি। এমন ভালো মানুষ খুবই কম দেখেছি। নিরহংকারী ও হাসি খুশি মানুষ ছিলেন।’

এ দিকে নিহত রুবিনার ভাই সড়ক পরিবহন আইনে গাড়ি চালক আজহার জাফর শাহকে একমাত্র আসামি করে মামলা করেছেন রুবিনার বড় ভাই জাকির হোসেন মিলন। মামলা নম্বর-০৫। এই মামলায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ১০৩ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আজহার জাফরকে গ্রেপ্তার দেখিয়েছে শাহবাগ থানা-পুলিশ। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘সাবেক শিক্ষকের গাড়িটি মোটরসাইকেলে বাম পাশে ধাক্কা দেয়। গাড়িটি থামালে এমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটতো না। তাকে বহু মানুষ থামার অনুরোধ জানিয়েছিল। এমনকি টিএসসিতে থাকা শাহবাগ থানার একটি টহল পুলিশ দলও তাকে থামানোর চেষ্টা করে কিন্তু তিনি থামেননি। এটি সড়ক দুর্ঘটনা নয়, এটি হত্যাকাণ্ড।’

ঘটনার পর পালিয়ে যাওয়ার জন্য এমনটা করেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়টি এখনই বলতে পারব না। ঘটনার পরে উত্তেজিত জনতার হাতে মারধরের শিকার হওয়ায় তিনি (ঢাবি শিক্ষক) ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তিনি সুস্থ হলে জানতে পারব কেন, কী কারণে তিনি এত দূর টেনে নিয়ে গেলেন। তবে এত দূর জেনেছি ওই শিক্ষকই গাড়ির মালিক। তিনি একাই থাকতেন। মাঝে মাঝে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন।’

মামলার বিষয়ে রমনা বিভাগের ডিসি বলেন, নিহত রুবিনার ভাইয়ের দায়ের করা মামলায় একমাত্র আসামি আজহার জাফরকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তবে তিনি চিকিৎসাধীন থাকায় তাঁকে পুলিশি প্রহরায় রাখা হয়েছে। সুস্থ হলে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গাড়িচাপায় নিহত রুবিনার ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের হাতে মরদেহ বুঝিয়ে দেওয়া হবে।

রুবিনার পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ৩ নং ভাগলপুর মসজিদে জানাজা শেষে রাজধানীর আজিমপুরে মা আয়েশা বেগমের কবরের পাশে দাফন করা হবে। 
 

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত