Ajker Patrika

দখল-দূষণে বিলুপ্তির পথে ‘রজতরেখা’

প্রতিনিধি, মুন্সিগঞ্জ
দখল-দূষণে বিলুপ্তির পথে ‘রজতরেখা’

প্রশস্ত নদীটি ৪৮০ ফুট চওড়া ছিল। এই নদী দিয়ে চলত লঞ্চ-ষ্টিমারসহ বিভিন্ন ছোট-বড় নৌযান। পাওয়া যেত মিষ্টি জলের হরেক রকম দেশীয় মাছ। নদীর পানি দিয়েই চলত কৃষি ও স্থানীয়দের দৈনন্দিন কাজ।

এসব কিছুই এখন অতীত। বলা হচ্ছিল মুন্সিগঞ্জ তথা বিক্রমপুরের ঐতিহ্যবাহী রজতরেখা নদীর কথা। নদীটির উৎপত্তি পদ্মা নদী থেকে। নদীর পূর্বপাশে মুন্সিগঞ্জ সদর ও পশ্চিম পাশে টঙ্গিবাড়ি উপজেলা। এ নদী দিয়ে দিঘিরপাড় হতে বেশনাল-পুরা বাজার-মাকাহাটি হয়ে সদরের কাটাখালি দিয়ে মুন্সিগঞ্জ শহরে লঞ্চ এবং বিভিন্ন নৌযানের মাধ্যেমে আসা যাওয়া করা হত। প্রায় ১২ কিলোমিটারের নদীটি মিসেছে ধলেশ্বরীতে গিয়ে। দখলের কারণে নদীটি তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। রূপ নিয়েছে মৃত খালে।

আজ মঙ্গলবার সকালে দিঘিরপাড়ে গিয়ে দেখা যায়, নদীর মুখে বালু দিয়ে বন্ধ করে পাশের জমি সমান উঁচু করে রাখা হয়েছে। এছাড়া খালে জমা পলি মাটি কেঁটে বিক্রি করা হচ্ছে। তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। এভাবে কমপক্ষে নদীর দুই’শ মিটার ভরাট করা হয়েছে। ভরাট ধরে সামনে এগোতেই নদীর অস্তিত্ব চোখে পড়ে। তবে নদী সম্পূর্ণ শুকিয়ে আছে। দিঘিরপাড় বাজার থেকে চর বেশনাল পর্যন্ত এক কিলোমিটারের মধ্যে নদীতে পানি নেই। এরপর থেকে সামান্য  কাদাপানি দেখা যায়। তবে নদীটির চওড়া  ৪০-৫০ ফুটে এসে দাড়িয়েছে।  

স্থানীয়রা জানান, বছর বিশেক আগেও নদীটি প্রবাহমান ছিল। বর্ষাকালে এই নদীতে কানায় কানায় পানি থাকতো এবং প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। এই নদী দিয়ে ছোট বড়  লঞ্চ-ষ্টিমার, ট্রলার,মালবাহী নৌকা চলাচল করত। এখন সবকিছুই অতীত। দখলের কারণে নদীটি তার অস্তিত্ব হারিয়েছে।

ভরাট করতে করতে এখন বিলীনের পথে ঐতিহ্যবাহী রজতরেখা নদী।  ছবি: রিয়াদ হোসাইনস্থানীয়রা আরও জানান, নদীর উৎপত্তি স্থল দিঘিরপাড়। সেখানে নদীর মুখবন্ধ করে দীর্ঘদিন ধরে বালুর ব্যবসা করে যাচ্ছে শিলই ইউপি চেয়ারম্যান আবুল হাসেমের ভাই সাবেক ইউপি সদস্য ইসমাঈল ব্যাপারী। এর ফলে নদীটির প্রবাহ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। এ সুযোগে নদীর দু’পাশ দখল করে দোকান ও স্থাপনা নির্মাণ করে ইসমাঈলের মত অনেক প্রভাশালীরা। ফলে নদীটি এখন মৃতখালে পরিণত হয়েছে।  

অনেকে অভিযোগ করে বলেন, স্থানীয় পর্যায়ের ভূমি অফিসের অসৎ কর্মচারীদের যোগসাজশে প্রভাবশালী দখলবাজরা নদীর জায়গার ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে নিয়েছে, তৈরি করেছে জাল দলিল। এসব ভুয়া জাল কাগজপত্র সম্বল করেই নানা রকম মামলা নিয়েই দীর্ঘ শত্রুতার সৃষ্টি। সেই সাথে পুলিশ-প্রশাসনকে ম্যানেজ করে দখল করে নিচ্ছে নদীর সীমানা। তাই মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না স্থানীয়রাও। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন বলেন, পদ্মার শাখা নদী থেকে বালু উত্তোলন করে কোটি টাকা বিক্রির করছে ইসমাঈল ও তার অনুসারীরা। রজতরেখা নদী দখল করে ১০ থেকে ১২টি দোকান নিমার্ণ করেছে ভূমিদস্যু ইসমাইল। প্রশাসনও সব কিছু জানা সত্ত্বেও কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এমন করে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সব খাল-নদী দখল করে নিচ্ছে।

এবিষয়ে পরিবেশবাদী শেখ রাসেল ফখরুদ্দীন জানান, রজতরেখা নদী দখলে খুব একটা বাঁধার মুখে না পড়ায় দখলদারদের নজর এখন নদী ও খালের জমির ওপর। বর্তমানে প্রভাবশালীরা আর লুকিয়ে নয়, প্রকাশ্যেই এ বেআইনি কাজ করে চলেছে।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কঠোর না হওয়ার কারণেই দিনদিন দখলদারদের সাহস বাড়ছে। ফলে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে খাল ও নদীর মতো জলাশয়ের জমি, বাড়ছে দূষণ।

স্থানীয় ব্যক্তি বিপুল খাঁন বলেন, নদীটি খনন করলে তার নাব্যতা পূর্বের মতো ফিরে পাবে। কিছুদিন আগে শুনেছিলাম নদীটি খনন করা হবে। এছাড়া নদীর দুই পাশের অবৈধ দখলকৃত জমি উদ্ধার করা হবে। পরে করোনা চলে আসার পর এ সম্পর্কে আর কোনো অগ্রগতি দেখিনি।

অভিযোগের বিষয়ে ইসমাঈল বেপারি বলেন, নদীর মুখটি তার রেকর্ড করা সম্পদ। ভূমি অফিস ১৮ বার এসে দেখে গেছে। তাই সেখান থেকে বালু কেটে বিক্রি করছেন বলেও জানান তিনি।  

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রশাসনিক এক কর্মকর্তা বলেন, রজতরেখা খালটি উদ্ধারে কাজ শুরু করা হয়েছিল। এ ব্যাপারে দখলকারীদের চিঠিও পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কোনো এক অদৃশ্য শক্তি এই খালটি উদ্ধারে কাজ বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছে।  

এবিষয়ে মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো. মনিরুজ্জামান তালুকদার বলেন, খাল ও নদী কারও ব্যক্তিগত সম্পদ নয়। এগুলো সরকারি সম্পদ, যে কোনো মূল্যে তা উদ্ধার করা হবে। খাল-নদী পুনরুদ্ধারে আমাদের দুইটি পরিকল্পনা রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় প্রথমে দখলমুক্ত করা হবে। পরবর্তীকালে নদী ও খালের স্বাভাবিক নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে খননকার্য পরিচালনা করা হবে।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

পাঠকের আগ্রহ

সম্পর্কিত